• ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪

কলকাতায় ইতিহাস-ঐতিহ্যের বড় নিদর্শন টিপু সুলতান মসজিদ

তিনশ বছরের পুরোনো কলকাতায় একই নামে দুইটি বিখ্যাত মসজিদ রয়েছে। এর আসল নাম টিপু সুলতান শাহী মসজিদ। সাধারণ মানুষ দুটিকেই টিপু সুলতান মসজিদ নামেই জানে। শুধু বাদ পড়েছে ‘শাহী’ শব্দটি।

প্রথমটি কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলা অঞ্চলে ও দ্বিতীয়টি প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড-দেশপ্রাণ শাসমল রোডের সংযোগস্থলের কোনে, যা টালিগঞ্জ নামেই বহুল পরিচিত। ধর্মতলা অঞ্চলের মসজিদটি নামাজের জন্য তৈরি হলেও, দ্বিতীয়টি শুধু নামাজরে উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল না, এর সঙ্গে একটি মিউজিয়াম তৈরির পরিকল্পনাও ছিল।

ঐতিহাসিক এই মসজিদ দুইটির নথি পাওয়া দুঃসাধ্য এমনকি মসজিদের পরিচালনা যারা করছেন তাদের কাছেও এ বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য নেই বললেই চলে। যারা ইমাম রয়েছেন তাদের কাছেও এর ঐতিহাসিক তথ্য প্রায় অধরা। মূলত কোনো প্রাচীন স্থাপত্য তখনই বিশেষভাবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় যখন সেটির নিদর্শন মানুষের কাছে সদর্থক হয়ে ওঠে। মসজিদ দুটির ঐতিহাসিকতার দলিল পেতে যথেষ্ট ঝরাতে হয়।

মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, টিপু সুলতানের পরিবারের অনেকেই এখনো জীবিত। কেউ থাকেন বিরাট অট্টালিকায়, কেউ অন্য কোথাও।

প্রিন্স গোলাম শাহ ওয়াকফ ট্রাস্টি থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে সম্পূর্ণ ইতিহাস উদ্ধার করা সম্ভব নয়। কিছু নথি এখনো থাকলেও তা উল্টিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা নেই কারোরই।

টিপু সুলতানের ১১তম ও সর্ব কনিষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ প্রিন্স গোলাম শাহ দ্বারা নির্মিত প্রথম মসজিদটি কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে। ১৮৩২ সালে ধর্মতলায় জমি কিনে এই অপরূপ সৌন্দর্যশালী মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন তার বাবা টিপু সুলতানের স্মরণে। যা সম্পন্ন হয় ১৮৪২ সালে। ১৬টি গম্বুজ ও ৪টি মিনার দ্বারা মসজিদটি নির্মিত। মসজিদের ভেতরে একসঙ্গে এক হাজার ৫০০ মানুষ নামাজ পড়তে পারে। ঈদের সময় মসজিদটিকে কেন্দ্র করে চারপাশে প্রায় ১৫ হাজারের মতো মানুষ নামাজ আদায় করে থাকেন। এটি কলকাতার সৌন্দর্যশালী স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি বড় নিদর্শন। মসজিদটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছেও একটি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

১৯৮০-র দশকে মাটির নিচ দিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার পর এই টিপু সুলতান মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর সেটি মেরামত করর জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়। পরবর্তীসময়ে টিপু সুলতান শাহী মসজিদ সুরক্ষা ও কল্যাণ কমিটি ও মেট্রো রেল যৌথ প্রচেষ্টায় মসজিদটি পুনরুদ্ধার হয়। ২০০৪ সালে সুনামি ঝড়ের সময়ে মসজিদটি ফের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মসজিদ কমিটিকে ২১ হাজার ৫০০ ডলার দান করেন। ফলে আসল মসজিদটির স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক অবলুপ্তি ঘটেছে অনেকটাই।

টিপু সুলতান মাইসোরের নবাব থাকা স্বত্বেও তার ছোট ছেলে মাইসোরের থেকে দূরে তার বাবার স্মরণে কলকাতায় কেনো এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন, এর পিছনেও রয়েছে একটি ইতিহাস। মাইসোর যার অতীতে নাম ছিল মহীশুর। বতর্মানে অঞ্চলটি দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে অবস্থিত। ওয়াদিয়ার রাজবংশের রাজত্বকালে ১৭৫০-এর দিকে সুলতান হায়দার আলীর জ্যেষ্ঠ পুত্র মহীশুরের নবাব হন টিপু সুলতান। পুরো নাম সইয়দ ওয়াল শহরীফ সুলতান ফতেহ আলী সাহাব টিপু।

টিপু সুলতানের রাজত্বকাল ছিলো ১০ নভেম্বর ১৭৫০ থেকে ৪ মে ১৭৯৯ পর্যন্ত। একদিকে তিনি যেমন সুলতান ছিলেন, অন্যদিকে ছিলেন বড় পণ্ডিত ও কবি। মাইসোরের রাজধানী শ্রীরঙ্গপট্টনম ব্রিটিশ শাসক বাহিনীর দ্বারা দখলকৃত হয়। টিপু সুলতানের মৃত্যুর ছ’বছর পর তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক ১৮০৬ সালে টিপুর পরিবারকে স্থানান্তরিত করে কলকাতায়। কারণ হিসাবে জানা যায় , একদিকে রাষ্ট্র থেকে ছত্রভঙ্গ করা ও তাদের নজরে রাখা। এইভাবেই ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠেন কলকাতাবাসী।

টিপু সুলতানের পুত্র গোলাম মোহাম্মদ যখন কলকাতায় আসেন তখন তিনি ছিলেন ছোট্ট শিশু। তিনিও ছিলেন তার পিতার মতোই বিভিন্ন গুণাবলী সম্পন্ন। ছিলেন বিভিন্ন সমাজ কল্যাণ কাজের সঙ্গে জড়িত।

টালিগঞ্জের দ্বিতীয়টি মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি একটি মিউজিয়াম তৈরি করার পরিকল্পনাও করেন গোলাম মোহাম্মদ। পাঁচ বিঘা জমির পশ্চিম পাশে এই মসজিদটি অবস্থিত। যেখানে নামাজের পাশাপাশি কলকাতার মানুষ যাতে পিতার ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে সেজন্য মিউজিয়াম তৈরির ভাবনা এসেছিলো তার মাথায়। তিনি মিউজিয়ামটির নাম দেন ‘মহীশূরের টাইগার’। কারণ টিপু সুলতান ‘টাইগার অব মহীশূর’ নামেও পরিচিত ছিলেন।

ঠিক হয়েছিল জাদুঘরটি টিপু সুলতান মসজিদের সামনে স্থাপন করা হবে না। এটা করা হবে কিছুটা দুরে। যেখানে থাকবে সুলতানের ব্যক্তিগত বস্তু, সামরিক অস্ত্র ও কামান। একসময় যে কামানে লোহার গোলা ব্যবহার করে শত্রুদের আঘাত হেনে ছিলেন তিনি। পাঁচটি বৃহৎ গম্বুজ, চারটি বড় মিনার ও ১৬টি ছোট মিনার দ্বারা মসজিদটি নির্মিত। ঈদের সময় এ মসজিদটিকে কেন্দ্র করে প্রায় ১০ হাজার মানুষ একসঙ্গে নামাজ আদায় করেন।

কিন্তু বর্তমানে টালিগঞ্জের এই মসজিদটির পরিবর্তন ভীষণভাবে লক্ষ্যণীয়। কোনো এক কারণে বছরের পর জলাশয়টি পানিশুন্য। মিউজিয়ামের কিছুই খুজে পাওয়া যায় না। কথিত আছে এখানে সুলতানের বংশধরের ১৩ জন আত্মীয় কবরে শায়িত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবরের চাকচিক্য বাড়লেও একজনেরও নাম খোদাই করা নেই তাতে। গোপন ক্যামেরা দিয়ে সর্বক্ষণ নজরদারি চললেও হেলায় পড়ে রয়েছে কামানের অংশ বিশেষ। কামানগুলো বাতিস্তম্ভ বা কোথাও লম্বা করে মাটিতে পুতে রাখা হয়েছে। জানা যায়, এই কামানের মধ্যে লোহার গোলা ঢুকিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার লর্ড ওয়েলেসলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন টিপু সুলতান।

বর্তমানে মসজিদটিকে সুসজ্জিত করে নামাজ চললেও, অচল মিউজিয়ামের অংশ। এতে ঐতিহাসিক গুরুত্ব যত ক্ষয় হতে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তত অস্বচ্ছ হবে।

Tags: , ,

Rent for add