ইমাম হোসাইন সোহেল : ৩০ অক্টোবর ২০২২, রবিবার, ৫:৩৮:৫০
ফেনী এখন আধুনিক একটি জেলা; কিন্তু এই জেলার ইতিহাস পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। প্রত্নতাত্বিকদের আবিষ্কার প্রমাণ করেছে এই জনপদের ঐতিহাসিক অবস্থান এবং গুরুত্ব। একদিকে পাহাড়িয়া অঞ্চল, অন্যদিকে সাগর সঙ্গমের বেলাভূমি বেষ্টিত ফেনীর এক বিশেষ রূপ, প্রকৃতি এবং স্বকীয়তা আছে। যুগ যুগ ধরে তাই ফেনীর মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ওপর এর বিশেষ প্রভাব লক্ষ্যণীয়। ফেনীর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যেমন হাজার বছরের প্রাচীন জনপদের ঐতিহ্য আছে, তেমনি ভাটির টানে পলি জমে ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া নতুন ভূমির ভূমিকাও আছে।
ফেনী মূলতঃ একটি সমতল অঞ্চল। ছাগলনাইয়া-পরশুরামের পূর্বভাগে একসময় টিলা-টক্কর, বন-জঙ্গল ছিল। কাজিরবাগের পোড়ামাটির টিলা ফেনীর একমাত্র উঁচু ভূমি। একসময় কালীদহ এলাকা ছিল বিরাট জলাভূমি। পঞ্চাশের দশকে কালিদাস-পাহালিয়া খাল কাটার কারণে এখন সেই জলাভূমি চাষাবাদযোগ্য হয়েছে। পূর্বাঞ্চলে উৎপন্ন হওয়া ফেনী নদী, ছোট ফেনী নদী, মুহুরী নদী এবং সিলোনিয়া নদী দক্ষিণে সাগরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এসব নদীবাহিত পলিমাটি দক্ষিণের ভূমি গঠনে যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি উর্বরতাও বাড়িয়েছে।
জমির আহমেদ রচিত ‘ফেনীর ইতিহাস’ থেকে জানা যায়, ফেনীর পূর্ব দিকের রঘুনন্দন পাহাড় থেকে কাজিরবাগের পোড়ামাটি অঞ্চলে হয়ত আদিকালে শিকারী মানুষের প্রথম পদচিহ্ন পড়েছিল। এখানকার ছাগলনাইয়া গ্রামে ১৯৬৩ সালে একটা পুকুর খননকালে নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের ব্যবহৃত একটা হাতিয়ার বা হাতকুড়াল পাওয়া যায়। পন্ডিতদের মতে ওই হাতকুড়াল প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরাতন। যা বর্তমানে ঢাকা জাদুঘরে সংরক্ষিত। প্রায় একই ধরনের হাতিয়ার বা মানুষের ব্যবহার করা সামগ্রী ময়নামতি, রাঙ্গামাটি এবং সীতাকুন্ড অঞ্চলে পাওয়া গেছে।
বৃহত্তর নোয়াখালীর মধ্যে পূর্ব দিকের ফেনী অঞ্চলকে ভূ-খণ্ড হিসেবে সবচেয়ে প্রাচীন বলেই বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। ফেনীর পূর্বভাগের ছাগলনাইয়া উপজেলার শিলুয়া গ্রামে রয়েছে এক প্রাচীন ঐতিহাসিক শিলামূর্তির ধ্বংসাবশেষ। জানা যায়, শিলামূর্তির অবস্থানের কারণে স্থানটি শিলুয়া বা শিল্লা নামে পরিচিত হয়েছে। প্রাচীনকালে হয়ত এখানে বৌদ্ধ ধর্ম ও কৃষ্টির বিকাশ ঘটেছিল। ঐতিহাসিক এন কে ভট্টশালী এবং রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে, শিলুয়া গ্রামের শিলামূর্তির ধ্বংসাবশেষ বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় সর্বাধিক একটি প্রাচীন উপকরণ।
ড. আহমদ শরীফ চট্টগ্রামের ইতিকথায় লিখেছেন, প্রাচীনকালে আধুনিক ফেনী অঞ্চল ছাড়া নোয়াখালীর বেশিরভাগ ছিল নিম্ন জলাভূমি। তখন ভুলুয়া (নোয়াখালীর আদি নাম) ও জুগিদিয়া (ফেনী নদীর সাগর সঙ্গমে অবস্থিত) ছিল দ্বীপের মতো। ফেনী নদীর তীরে রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বীর বাঙালী শমসের গাজীর রাজধানী ছিল। তিনি এখান থেকে যুদ্ধাভিযানে গিয়ে রৌশনাবাদ ও ত্রিপুরা রাজ্য জয় করেন।
মূলতঃ প্রশ্ন হচ্ছে ফেনীর নাম কিভাবে ‘ফেনী’ হলো? সবচেয়ে প্রচলিত এবং গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে ফেনী নদীর নামানুসারেই এ অঞ্চল কিংবা জনপদের নাম রাখা হয়েছে ফেনী। কিন্তু সেই ‘ফেনী’ শব্দটির উৎপত্তি হলো কোথা থেকে? জমির আহমেদ তার ফেনীর ইতিহাস বইতে লিখেছেন, ‘নদীর নামে ফেনী- দেশি-বিদেশে বহুল পরিচিত একটি নাম। নামকরণের দিক থেকে ফেনীর একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশের নদ-নদীর নামানুসারে কোনো জনপদের নামরকণ তেমন একটা দেখা যায় না। সম্ভবতঃ ফেনী এ ব্যাপারে একটা ব্যতিক্রম। ফেনী নামে পরিচিত নদীর ¯স্রোতধারায় প্রায় তিনদিক পরিবেষ্টিত জনপদ ফেনী নামে পরিচিত হয়েছে।’
ফেনীর ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে রচিত বিপুল তথ্যের সমাহার একমাত্র পাওয়া যায় ১৯৯০ সালে চট্টগ্রামের সমতট প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত জমির আহমেদের ‘ফেনীর ইতিহাস’ বইতেই। এছাড়া অনেকেই ফেনীর ইতিহাস এবং ঐতিহ্য নিয়ে বই লিখেছেন। এর মধ্যে সাংবাদিক ও গবেষক ফিরোজ আলম উল্লেখযোগ্য।
২০২০ বইমেলা উপলক্ষে তিনি প্রকাশ করেন ‘ফেনী জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ নামক বইটি। তবে, যারাই ফেনী নিয়ে কোনো বই লিখতে যান কিংবা ঐতিহাসিক তথ্য সম্বলিত নিবন্ধ লিখতে যান, অধিকাংশেরই মূল তথ্যসূত্র হয়ে ওঠে জমির আহমেদের ‘ফেনীর ইতিহাস’ বইটি। সেখানেই ফেনীর নামকরণের কারণ হিসেবে বেশ কিছু কিংবদন্তী তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, যে কোনো স্থানের নামকরণের ইতিবৃত্ত বা উৎপত্তি রহস্য সম্পর্কে কিছু না কিছু জনশ্রুতি বা কিংবদন্তি প্রচলিত থাকে। তেমনি ফেনী নামকরণ সম্পর্কেও স্থানীয়ভাবে মুখরোচক জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। এ সবের মধ্যে কোনটা বাস্তব আর কোনটা কল্পনা তা নির্ণয় করা কঠিন।
ফেনী কিভাবে ‘ফেনী’ হলো- তা নিয়ে প্রচলিত কিংবদন্তী এবং জনশ্রুতিগুলোই এখানে তুলে ধরা হলো-
** কারো কারো মতে কুরু-পান্ডবের যুদ্ধকালে পৌন্ড্রবর্দ্ধনের বা উত্তর বঙ্গের বিরাট রাজার এক সামন্তের নাম ছিল ফনী রাজা। তার রাজ্য ছিল দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গে। উত্তর বঙ্গের বিরাট রাজার দীঘি, বিরাট রাজার হাট-ঘাট ইত্যাদিকে মহাভারত বর্ণিত বিরাট রাজার স্মৃতিবাহী বলে ধারণা করা হয়। আর বিরাট রাজার সামন্ত ফনী রাজার রাজধানী ছিল ফেনীর অদুরে পোড়ামাটির পাহাড়ে। যা শিলার শহর নামে পরিচিত ছিল। তাই ধারণা করা হয় ফনী রাজার নামানুসারেই ফনী বা ফেনী নামকরণ করা হয়েছে। আরও ধারনা করা হয় ফনী রাজার রানীর নামে এক সময় ছিল রানীর ঘাট, যা বর্তমানে রানীর হাট নামে পরিচিত হয়েছে।
** দূর অতীতে ফেনীর বিরাট এলাকা ছিল সাগর বা নিম্ন জলাভূমিতে নিমজ্জিত। এখানকার অথৈ জলে ছিল শুধু ‘কচুরী পানা’ বা ‘কচুরী ফেনা’। অন্য এক জনশ্রুতি অনুযায়ী এখানকার জলাভূমিতে একসময় দেখা যেত বুদবুদ বা ফেনা। তাই ‘ফেনা’ (তা কচুরী ফেনা হোক কিংবা বুদবুদের ফেনা হোক) বাহিত গ্রোতধারা কালক্রমে ফেনী শব্দে পরিণত হয়েছে।
** প্রাচীনকালে এখানে বিচরণ করতো শুধু ফনী আর ফনী অর্থ্যাৎ সাপ। সাপের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা ফনী বা সাপের যম বলে পরিচিত ফনী মনসা গাছ লাগাত। হয়ত খাল-বিল, নদী-নালায় সাপের আধিক্যের কারণে এখানকার বহমান নদী ‘ফনী নদী’ নামে পরিচিত হয়েছিল। যা কালক্রমে ফেনী শব্দে পরিণত হয়।
** কারো কারো মতে, প্রাচীনকাল থেকে এখানকার পাহাড়িয়া ¯স্রোতধারা বর্ষাকালে সাপের ফনার মত ফুলে উঠতো এবং তা সর্পিল গতিতে প্রবাহিত হয়ে মানুষের জানমাল ও সম্পদের ভীষণ ক্ষয়-ক্ষতি করতো। তাই ফনী শব্দ থেকে এখানকার প্রধান নদী ফেনী নদী নামে খ্যাত হয়েছে।
মধ্যযুগের কবি ও সাহিত্যিকদের কবিতা, কাব্য ও পুঁথিপত্রে একটা বিশেষ নদীর গ্রোতধারা ও ফেরী পারাপারের ঘাট হিসেবে ‘ফনী’ শব্দ পাওয়া যায়। পনের শতাব্দীর মধ্যভাগে পণ্ডিত জটাধর ভট্টচার্যের রচিত অভিধানতন্ত্রম গ্রন্থে তিনি আত্মপরিচয় দানকালে জাহ্নবীকুলের পৈত্রিক বাস্তুভিটা ত্যাগ করে বঙ্গালভূমিতে এসে ফনীতটস্থ দেবকড় গ্রামে বসতি স্থাপনের কথা বলেছেন।
ষোড়শ শতাব্দীতে কবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর পরাগলপুরের বর্ণনাকালে লিখেছেন, ‘ফনী নদীতে বেষ্টিত চারিধার, পূর্বদিকে মহাগিরি, পার নাই তার।’ এই দুই পণ্ডিতের ভাষায় ‘ফনী’ নামে একটা নদীর নাম পাওয়া যায়। সতের শতকের প্রথমভাগে মির্জা নাথানের ফার্সি ভাষায় রচিত ‘বাহরিস্তান-ই-গায়েবীতে’ ‘ফনী’ শব্দ ফেনীতে পরিণত হয়েছে। তিনি দুটি ফেনী নদীর কথা উল্লেখ করেছেন। আঠার শতকের শেষভাগে কবি আলী রেজা কানু ফকির তার পীরের বসতি হাজিগাঁওর (মিরসরাইতে) অবস্থান সম্পর্কে লিখেছেন,
‘ফেনীর দক্ষিণে এক শহর উপাম,
হাজিগাঁও করিছিল সেই দেশের নাম।’
কবি মুহাম্মদ মুকিম তার পৈতৃক বসতির বর্ণনাকালে বলেছেন, ‘ফেনীর পশ্চিমভাগে জুগিদিয়া দেশে।’ বলাবাহুল্য, তারাও নদী অর্থে ফেনী শব্দ ব্যবহার করেছেন। মনে হয়, আদী শব্দ ‘ফনী’ মুসলমান কবি ও সাহিত্যিকদের ভাষায় ‘ফেনীতে’ রূপান্তরিত হয়েছে।
তবে ফেনী জেলার পুরনো নাম ছিল বীর বাঙালী শমসের গাজীর নামে, ‘শমসের নগর’। ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, ১৮৭২-৭৪ সালের মধ্যে মোগল আমলের আমীরগাঁও থানা নদী ভাঙ্গনের মুখোমুখি হলে তা ফেনী নদীর ঘাটের অদূরে খাইয়্যারাতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। সেই থানাটি কোম্পানীর কাগজপত্রে ফেনী থানা (ফেনী নদীর অদূরে বলে) নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপর ১৮৭৫ সালে নতুন মহকুমার পত্তন হলে খাইয়্যারা থেকে থানা দপ্তরটি মহকুমা সদরে স্থানান্তরিত হয় ও নতুন মহকুমাটি ফেনী নামে পরিচিতি লাভ করে।
মীরসরাই, ছাগলনাইয়া ও আমীরগাঁও-এর সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছিল ফেনী মহকুমা। প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন কবি নবীনচন্দ্র সেন। ১৮৭৬ সালে মীরসরাইকে কর্তন করে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ১৮৮১ সালে মহকুমা সদর দপ্তর ফেনী শহরে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৮৪ সালে সারাদেশের মত বৃহত্তর নোয়াখালীতেও প্রশাসনিক পুনর্গঠন করা হয়। যার মাধ্যমে ফেনী মহকুমাকে আলাদা একটি জেলার মর্যাদা দেয়া হয়। মূলতঃ ১৮৭৫ সালে মহকুমা গঠন করার পর থেকেই এর অধীনস্থ থানা এবং জনপদগুলো ফেনী নামেই পরিচিত হতে থাকে।
Rent for add