ইতিহাস ঐতিহ্য ডেস্ক : ৯ নভেম্বর ২০২২, বুধবার, ৬:০৩:২৩
ফেনী জেলায় প্রচুর দর্শনীয় স্থান রয়েছে, রয়েছে ঐতিহাসিক অনেক জায়গা, যেসব জায়গার সঙ্গে জুড়ে আছে হাজার বছরের ইতিহাস। ফেনী জেলা আয়তনে ছোট হলেও এটি একটি উন্নয়নশীল জেলা বর্তমানে। অর্থনীতির দিক থেকেও এগিয়ে রয়েছে ফেনী জেলা।
ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর বিখ্যাত মুখ ও স্থানে পরিপূর্ণ এই জেলার ইতিহাস। অনেকগুলো নামকরা স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো ফেনী জেলার একমাত্র জাদুঘর।
ফেনীর মহিপাল মোড় মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে ফেনী-নোয়াখালী সড়কের ডানপাশে মাতুভুঁইয়া ব্রিজের কাছে তৎকালীন লক্ষণপুর গ্রাম, যেটি বর্তমানে সালামনগর নামে পরিচিত। সেখানেই ভাষা শহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর অবস্থিত।
ভাষা শহীদ আব্দুস সালামের জন্ম ১৯২৫ সালে ২৭ নভেম্বর, দাগনভূঁইয়া উপজেলার মাতুভুঁইয়া ইউনিয়নের লক্ষণপুর গ্রামে (সালাম নগর)। তার পিতার নাম ফজিল মিয়া। ৪ ভাই ৩ বোনের মধ্যে সালাম ছিলেন সবার বড়। ’৫২-র ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়ার আগে ২০ বছর বয়সে ছোট বোন তরিকুন নেছা মারা যান।
১৯৭৬-এর অক্টোবরে হতদরিদ্র বাবা ফাজিল মিয়া (৮৫), এরপরে ১৯৮২ সালে মা দৌলতের নেছা (৮৫) ও ছোট ভাই সাহাবউদ্দিন (৫৫) ১৯৯৯ সালে, ছোট বোন কুরফুলের নেছা (৭৫) ২০০২ সালে, ভাই আবদুস ছোবহান ও ২০০৭ সালের ৩রা জানুয়ারি বোন বলকিয়তের নেছা মারা যান।
সৈয়দ সালাম মাতৃভূঞা করমুল্যা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৮ম শ্রেণী পাস করে দাগনভূঞা কামাল আতাতুর্ক হাইস্কুলে ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ৯ম শ্রেণীতে পড়ালেখা চলাকালে জেঠাতো ভাই হাবীবের সহযোগিতায় ঢাকার ৫৮, দিলকুশা মতিঝিল ডাইরেক্টর অব ইন্ডাস্ট্রিজ কমার্স-এ পিয়নের চাকরিতে যোগদান করেন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন চলাকালে ঢাকায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের শিল্প বিভাগে পিয়নের চাকরি করতেন। ভাষা আন্দোলনের সময় আবদুস সালাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে নীলক্ষেত ব্যারাকের ৩৬বি নং কোয়ার্টারে বসবাস করতেন।
’৫২-র ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সালাম কয়েক দিনের ছুটি কাটিয়ে বাড়ি থেকে ঢাকায় চাকরিস্থলে ফিরে যান। রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে তখন ফেব্রুয়ারি মাস ঢাকা ছিল উত্তাল। আন্দোলন চলছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, রাজপথ সবখানে। সে আন্দোলনে চঞ্চল ২৭ বছরের তরুণ আবদুস সালামের হৃদয়েও আন্দোলনের ডাক ছুঁয়ে যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে সারা দেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস।
ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য তৎকালীন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। সভা, সমিতি, মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু বাংলার ধামাল ছেলেরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সভা সমাবেশ করলো এবং মিছিল নিয়ে এগিয়ে গেলো। মিছিলটি বর্তমানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গেলে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালায়। সে মিছিলে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিকসহ নাম না-জানা আরও অনেকের সঙ্গে সালামও গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ সালামকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেদিন সন্ধ্যায় টেলিগ্রামে সালামের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে সালামের বাবা ফাজিল মিয়া, জেঠাতো ভাই হাবিব উল্যাহ ও প্রতিবেশী মকবুল আহমেদ ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা ছুটে যান। দীর্ঘ দেড় মাস ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ৭ই এপ্রিল তিনি মারা যান।
তার লাশ বাড়িতে আনার চেষ্টা করা হলেও তখন অবরোধ আর হরতালের কারণে সম্ভব হয়নি। ঢাকাস্থ আজিমপুর গোরস্থানে জানাজা শেষে অজুখানার উত্তর পাশে ৫-৬টা কবরের পর সালামের দাফন সম্পন্ন হয় বলে জানাজায় অংশগ্রহণকারী মকবুল আহমেদ জানান।
২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ভাষা শহীদ সালামে স্মৃতি রক্ষার্থে তার গ্রামের বাড়ি ফেনীর সালামনগরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভাষা শহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’। ভাষা শহীদ সালামে স্মৃতি রক্ষার্থে জাদুঘরটি স্থাপন করে বাংলাদেশ সরকার।
এডিপির অর্থায়নে ১২ শতক জমিতে সাড়ে তেষট্টি লাখ টাকা ব্যয়ে সালামনগরে জাদুঘরটি স্থাপন করা হয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ২০০৮ সালের ২৬শে মে সালাম স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারটি উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনের সময় প্রায় ৫ হাজার মূল্যবান বই গ্রন্থাগারের জন্য প্রদান করা হয়। উদ্বোধনের পর তিন বছর কোনো লাইব্রেরিয়ান ও কেয়ারটেকার নিয়োগ না দিলেও ২০১১ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি শহীদ আবদুস সালামের ছোট ভাইয়ের মেয়ে খাদিজা বেগমকে মাসিক ছয় হাজার টাকা বেতনে গ্রন্থাগারিক পদে নিয়োগ দেয়া হয়।
তবে প্রতিষ্ঠার আট বছরেও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি এটি। গ্রন্থাগারের জন্য বরাদ্দ পাঁচ হাজার বই আলমারিতেই তোলা হয়নি। তার ওপর নিয়মিত লাইব্রেরি খোলা না থাকায় বইপ্রেমিরা পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। লাইব্রেরিয়ান বা কেয়ারটেকার কেউ কার্যালয়ে না আসায় দিন দিন সৌন্দর্য হারাচ্ছে জাদুঘরটি। তবে, ২১শে ফেব্রুয়ারি এলেই পুস্পস্তবক অর্পণের জন্য জাদুঘরের পাশে নির্মিত শহীদ মিনারে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদচারণা পড়ে।
এছাড়া ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না করায় চুরি হয়ে যাচ্ছে ভবনের নানা সরঞ্জাম বলে জানা গেছে। এলাকাবাসির দাবি, গ্রন্থাগারের পাশে লক্ষ্মণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সালামের নামে নামকরণ করা হোক।
তবুও প্রতিদিন বহু মানুষ এ জাদুঘর দেখতে আসেন। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ফেনীর একমাত্র জাদুঘর এভাবেই বছরের পর বছর নিদর্শন হয়ে টিকিয়ে রেখেছে নিজস্বতা।
কিভাবে যাওয়া যাবে এই জাদুঘর দেখতে!
ফেনী শহর বা ফেনীর মহিপাল মোড় থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ফেনী-নোয়াখালী সড়কের ডান পাশে মাতুভূঞা ব্রিজের কাছেই তৎকালীন লক্ষণপুর গ্রাম বর্তমানে সালামনগর-এ ভাষা শহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর আবস্থিত। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের মহিপাল মোড় থেকে মাত্র ৮ বা ১০টা বাস ভাড়া। সিএনজি চালিত রিজার্ব অটোরিক্সায় ভাড়া ৫০ থেকে ৭০ টাকা।
Tags: ২১ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, ফেনী, ভাষা দিবস, ভাষা শহীদ সালাম, ভাষা শহীদ সালাম জাদুঘর
Rent for add