মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক : ১৮ নভেম্বর ২০২২, শুক্রবার, ৫:৫৬:১৮
اسْتَأْجَرَتْ خَدِيجَةُ رِضْوَانُ اللَّهِ عَلَيْهَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ سَفْرَتَيْنِ إِلَى جَرَشَ
“খাদিজা (রা.) রাসূলুল্লাহকে (সা.) জারাশের উদ্দেশ্যে পরিচালিত দুইটি বাণিজ্যিক সফরে নিয়োগ করেছিলেন।” [মুসতাদরাক, ৪৭৮১]।
আরবী একই বানানে দু’টি শহরের নাম প্রসিদ্ধ ছিলো। একটি জারাশ আর অন্যটি জুরাশ। জুরাশ ছিলো ইয়ামেনের একটি পুরোনো নগরী [বিদায়াহ নিহায়াহ]। কুরাইশদের দক্ষিণমুখি বাণিজ্যিক কাফিলার শেষ সীমান্ত ছিলো জুরাশ। নবীজির দাদা আব্দুল মুত্তালিবের সহোদর ‘মুত্তালিব’ এখানে ব্যবসায়িক কারবার পরিচালনার সুযোগ উম্মুক্ত করেন। তিনি এ স্থানে মারা গেলে জুরাশে-ই তাকে দাফন করা হয়।
এখানকার প্রতিনিধিদের সাথে আলাপচারিতার সময় ‘কাশার’ নামক একটি পাহাড়ের নাম ‘শাকার’ নামে রূপান্তর করে দিয়েছিলেন নবীজি (সা.)। নবীজির প্রতিনিধি ‘সুরাত ইবন আব্দিল্লাহ আল-আজদী’ ও তাঁর সংগ্রাম এ স্থানের অম্লান ইতিহাস [বাইহাকী, দালাইল, ২১২৭]।
নবীজি (সা.) এখানকার লোকদের আঙ্গুর ও খেজুর রসের মিশ্রণ এবং নতুন ও পুরোনো খেজুর রসের মিশ্রণ থেকে নিষেধ করেছিলেন [মুসলিম, ৩৬৯২]।
আরও অনেক স্মৃতি আছে এখানকার। সেসব অন্য জায়গায় আলাপ করা যাবে। এখানে যে স্থান তা তৎকালীন প্রাচীন শাম বা সিরিয়ার একটি প্রসিদ্ধ শহর ‘জারাশ’। ইয়ামানের জুরাশ নয়; বরং বর্তমান জর্ডানের জারাশে বাণিজ্য কাফিলা পরিচালনা করেছিলেন নবীজি (সা.) [যাদুল মাআদ, ১/১৫৪]।
জারাশ বর্তমান জর্ডানের রাজধানী ‘আম্মান’ থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ শহর। জর্ডানের রাজধানী আম্মান ও প্রসিদ্ধ নগরী ‘ইরবিদ’-এর মধ্যস্থলে রোমান শাসনের স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জারাশ। শহরটি ডেকাপলিশের (Decapolis) দশটির নগরীর একেবারে দক্ষিণের নগরী। থিয়েটার, ওভাল গেইট, কোলান্ড স্ট্রীটসহ প্রায় বারটির মতো রোমান নির্মিত স্থাপত্য রয়েছে এখানে। আল-হামাভী নগরীটির বর্ণনায় উল্লেখ করেন,
‘জারাশ একটি বড় নগরী; অথচ এখন তা পরিত্যক্ত! একজন প্রত্যক্ষকারী আমাকে বলেছে যে, তা এখন বিধ্বস্ত নগরী! তাতে পুরোনো অনেক কূপ রয়েছে; তার বুকচিরে বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত হয়েছে নদীর প্রবাহ। বালাকা ও হাওরান এলাকার কালো পাহাড়ের পূর্বপাশে শহরটির অবস্থান। এখানে অনেকগুলো পাহাড় ও গ্রাম আছে, সবগুলোকে ‘জাবালু জারাশ’ বলা হয়। এ স্থানের দিকে সম্পৃক্ত করে জারাশের বিস্তির্ণ মাঠকে ‘হিমা জারাশ’ বলা হয় [মুজামুল বুলদান]।’
বর্তমান জারাশ ও বালাকা প্রদেশের মাঝখান দিয়ে ‘যারকা’ নদী প্রবাহিত। আসলে তা নদী নয়; বরং পাহাড়ী নালা যা মৃত সাগরে গিয়ে মিশে গেছে। ইয়ারমূক ও যারকা ইত্যাদি পাহাড়ী নালাগুলো-ই আরবে একেকটি নদী। এসব দিয়ে যতসামান্য প্রবাহিত পানি মৃত সাগরের প্রবাহে যুক্ত হয়।
জারাশ শহরের পদপ্রান্তে রয়েছে ‘মকামু নবী হুদ’। নবী হুদ (আ.) আদ জাতির আবাসভূমি ‘আহকাফ’ অঞ্চলে প্রেরিত হয়েছিলেন [সূরা আহকাফ: ২১]। এ অঞ্চলটি ইয়ামানের হাদরামাওত থেকে ওমান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা [ফতহুল বারী, ৬/৪৬৪]। ‘হাদারামাওত’ অর্থ মৃত্যু উপস্থিত হওয়া। নবী হুদের মৃত্যু সে অঞ্চলে-ই হয়েছিলো বিধায় এ অঞ্চলের নাম ‘হাদারামাওত’।
সেখানে ‘শাবাম’ নামক পাহাড়ে নবী হুদের (আ.) রওযা রয়েছে [ইবন জুনাইদাল, মুজাম আল-আমকিনা, ১৯০]। কিন্তু জারাশের ‘মাকামু হুদ’ কীভাবে আসলো? হতে পারে তিনি বাইতুল মাকদিসে যাতায়াতের সময় জারাশের এ স্থানে বিশ্রাম নিয়েছেন [নূহ মোস্তফা মুস্তফা আল-ফাকীর, দালীল আস-সিয়াহা আল-ইসলামিয়্যাহ, পৃ. ৬৮]
জারাশ থেকে পশ্চিম দিকে খুব কম দূরুত্বে-ই রয়েছে জর্ডান নদী। জারাশ এবং জর্ডান নদীর পূর্ব পাড়ের মধ্যবর্তী অঞ্চল পাহাড়ী এলাকা। মৃতসাগরের পশ্চিম প্রান্ত থেকে জারাশের পশ্চিমের পাহাড়ী ভূমির মাঝে আছে নবী ইউশা (আ.) ও নবী শুআইবের রওযা। তারপর জর্ডান নদীর একেবারে লাগোয়া উর্বর ভূমি ‘আগওয়ার’ বা ভাটি অঞ্চল।
তারপর জর্ডান নদীর পশ্চিম পাড়ে নাবলূস আর বাইতুল মাকদিস। নবীজি (সা.) কী অল্প দূরত্বে থাকা জর্ডান নদীর পূর্ব তীর ভ্রমণে গিয়েছিলেন? মন বলছে গিয়েছিলেন! সত্য হচ্ছে যাননি। গিয়ে থাকলে সেটা হারানো ইতিহাস। কিন্তু গিয়েছিলেন নবীজির সাহাবী আবূ উবাদাহ ইবন আল-জাররাহ (রা.) বিজয়ে ইতিহাস গড়তে গড়তে! গিয়েছিলেন মুআয ইবন জাবাল (রা.)! গিয়েছিলেন শুরাহবীল ইবন হাসানাহ (রা.)! গিয়েছিলেন যাররাহ ইবন আযওয়ার (রা.)! গিয়েছিলেন কিন্তু আর ফিরেননি! তাঁরা স্মরণীয় হয়ে আছেন মহামারীর শহীদ “শুহাদা আমওয়াস” নামে। আমওয়াস শহীদেরা এখনোও বিশ্রামে আছেন সেখানে-ই।
মক্কা থেকে নবীজির (সা.) বাণিজ্যিক কাফিলা দুই দুু’বার গিয়েছেন জারাশে এবং আবার ফিরে এসেছে মক্কায়। মাইসারা কী ছিলেন এ দুই সফরে? সে ইতিহাস এখন উদ্ধারের কোনো পথ নেই। সাথে কে ছিলেন তাও হারানো ইতিহাসের অংশ। তবে নবীজির (সা.) সে দু’টি সফরও ছিলো সফল ও স্বার্থক। খাদিজা (রা.) হতে তিনি উত্তম বিনিময় পেয়েছিলেন।
“জাবির (রা.) বলেন, ‘খাদিজা (রা.) রাসূলুল্লাহকে (সা.) জারাশের উদ্দেশে দুইটি বাণিজ্যিক সফরে নিয়োজিত করেছিলেন; প্রত্যেক সফরে-ই তিনি তাকে একটি করে উট দিয়েছিলেন।” [বাইহাকী সুনান আল-কুবরা, ১০৭৫২]
নবীজিকে তিনি খুঁশি করে দিয়েছিলেন! আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং তাঁকেও সন্তুষ্ট করে দিয়েছিলেন। জান্নাতে চিরস্থায়ী প্রবেশ করেছেন। উত্তম বিনিময় পেয়েছেন প্রভুর কাছে।
جَزَاؤُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۖ رَّضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ۚ ذَٰلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ
“তাদের রবের কাছে আছে তাদের পুরস্কার: স্থায়ী জান্নাত, যার নিচে নদীমালা প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তার প্রতি সস্তুষ্ট। এটি তার জন্য, যে তার রবকে ভয় করে। [বাইয়্যিনা: ৮]।
Tags: নবিজীর ব্যবসায়িক জীবন, মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক, সীরাত, সীরাতে রাসুল (সঃ)
Rent for add