মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক : ২১ নভেম্বর ২০২২, সোমবার, ৫:৪৯:৩৮
أَيُّ هَجَرٍ أَعَزُّ؟ ” قُلْنَا: الْمُشَقَّرُ. قَالَ: ” فَوَاللَّهِ، لَقَدْ دَخَلْتُهَا وَأَخَذْتُ إِقْلِيدَهَا ”
“হাজারের কোন ভূমিটি অতি প্রিয়? আমরা বললাম: ‘আল-মুশাক্কার। তিনি (সা.) বললেন: ‘আল্লাহর শপথ! আমি তাতে প্রবেশ করেছি এবং তার খিলান ছুঁয়েছি” [মুসনাদ আহমদ, ১৭৪৮১]
শিরোনাম হয়তো পাঠকের মনে বিস্ময় তৈরি করে দিয়েছে। নবীজি (সা.) কী আদৌ বাহরাইনে গিয়েছিলেন? হাদীসে যে বাহরাইন আছে তা কোন অঞ্চল?
পারস্য উপসাগরে অবস্থিত সৌদির উত্তর-পূর্ব উপকূলে সৌদির সাথে ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘জিসর আল-মালিক ফাহাদ’ নামক ব্রিজের মাধ্যমে সংযুক্ত আধুনিক একটি রাষ্ট্রের নাম ‘কিংডম অব বাহরাইন’। আমাদের দেশে যা বহুল পরিচিত ‘বাহরাইন’ নামে।
মাত্র ৭৮০ বর্গকিলোমিটারের দেশটি মালদ্বীপ ও সিংগাপুরের পর ক্ষুদ্রতার দিক থেকে এশিয়ার তৃতীয় স্থানে। দেশটির সাথে আমাদের একটি অপূর্ব মিল যে তা ১৯৭১ সনে সার্বভৌম অর্জন করে। কিন্তু নবীজির (সা.) ভ্রমণ করা ‘বাহরাইন’ অঞ্চলটি তা নয়! তাহলে?
আঠারো শতকের আগে ‘বাহরাইন’ নামে আরবেরা যে অঞ্চলকে জানতো তা বসরা এবং ওমানের মাঝামাঝি আরব উপদ্বীপের পূর্বাঞ্চল [আল-বাকরি, মুজাম মা উসতিজামা, ১/২৮৮]। পারস্য উপসাগরকে পূর্বে রেখে ইরাকস্থ বসরার দক্ষিণ থেকে কুয়েত, সৌদির আল-আহসা হয়ে মধ্যাঞ্চলে ‘আল-ইয়ামামার (রিয়াদ) সাথে সংযুক্ত হয়ে বাহরাইন, কাতার ও আরব আমিরাতকে অর্ন্তভুক্ত করে ওমানের উত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত পূর্ব আরবের পুরো উপকূলীয় অঞ্চলটি অন্তত দশ শতাব্দিকাল ‘বাহরাইন’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলো [ক্লিভ হোলস, কালচার এ- সোসাইটি ইন ইস্টার্ণ এরাবিয়া, ১১]।
বাইরাইনের প্রধান নগর ছিলো ‘হাজার’ এবং নগরের অধিবাসী ছিলো আবদুল কায়িস গোত্র। অন্যান্য শহর ‘আল-আহসা, আল-কাতীফ, বাইশা, আল-জারাহ, আল-খাত। সেখানে প্রবাহিত হৃদ ও মিষ্টি পানির ঝর্ণা আছে; প্রচুর পরিমাণে খেজুর ও ফল-ফলাদি হতো তাতে; একেকটি বাগান কয়েক মাইল জুড়ে বিস্তৃত ছিলো [আল-হিময়ারী, আর-রাওদুল মুতার, ৮২]।
বাহরাইন’ মানে দু’টি সাগর। আরব গবেষক উস্তাদ ‘হামদ আল-জাসির’ বাহরাইনের নামকরণের বেশ কয়েকটি মতামত একসাথ করেছেন। একটি হতে পারে বাহরাইনের গ্রামগুলোর প্রান্তে আছে একটি হৃদ যার উপর ‘আল-আহনার সদর দরজা দাঁড়িয়ে। হাজার (আল-কাতীফের পুরনো নাম) এবং সাগরের মাঝে দশ ফরসখ দূরুত্ব। আর হৃদটির প্রায় তিন মাইল পরিমাণ প্রবাহিত হলেও তাতে পানি বৃদ্ধি পায় না; বরং স্থির ও লবণাক্ত’ [আল-আজহারী]।
আরেকটি কারণ হতে পারে, ‘জাজিরাতুল আওয়ায়িল’ (বর্তমান বাহরাইন)-এর সাথে পারস্যের সাথে জলপথে একটি যাতায়াত ছিলো এবং স্থল পথে আরবের সাথে একটি যোগাযোগ ছিলো যা প্রায় ছয় মাইল দীর্ঘ ও প্রশস্ত ছিলো [আল-ইদরিসী, নুযহাতুল মুশতাশ]।
এজন্য বর্তমান বাহরাইনসহ পুরো অঞ্চলটির নাম বাহরাইন ছিলো। অন্য একটি হচ্ছে, ‘বাহরাইনে মুহাল্লাম ও কাদবা নামে দুটি প্রসবণ ছিলো, যাদের মধ্য দূরুত্ব ছিলো তিন দিনের ভ্রমণ সমান। একটি পাড়ে ‘হাজার’ অন্যটির পাড়ে ‘কাতীফ’। কাতীফের আরেক নাম ‘আল-খাত’ [আল-আসমাঈ, কিতাব আন-নাসর]।
সহীহ বুখারীর স্থানসমূহের গবেষক ‘সাদ জুনাইদাল’ আরব উপদ্বীপের ভৌগলিক ইতিহাস বিচার করে দেখিয়েছেন যে, আধুনিক ‘বাহরাইন’ ও সৌদির ‘আল-আহসা’র মাঝে এক সময় স্থলসংযোগ ছিলো। সময়ের আবর্তে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে স্থান দুটি আলাদা হয়ে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন ‘আওয়ায়েল’ অংশটি ‘বাহরাইন’ এবং আরব উপদ্বীপের সাথের অংশটি ‘আল-আহসা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে [মুজাম আল-আমকিনা, ৬২]।
হাদীসের বিভিন্ন ঘটনাবলীতে ‘বাহরাইন’ ও ‘হাজার’ পরস্পরকে প্রতিস্থাপন করেছে। হয়তো হাজার-ই ছিলো মূল শহর বা অন্যতম প্রধান শহর। হয়তো মুসলিম প্রাধান্যের দিক থেকে হাজার-ই ছিলো অগ্রসর। হাজারের বিস্তারিত পরিচিতির পূর্বে নবীজির (সা.) সাথে হাজারের অধিবাসীদের একটি সংলাপ শুনে নেয়া যায়, যে পাঠে নবীজির সে অঞ্চলে যাবার অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে।
“শিহাব ইবন আব্বাদ বলেন, তিনি আবদুল কায়িস গোত্রের লোকদের বলাবলি করতে শুনলেন: ‘আমরা রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে আগমণ করলাম, যা তাদের আনন্দ বাড়িয়ে দিলো। আমরা জনতার কাছে পৌঁছালে তারা আমাদের জন্য বসার স্থান প্রশস্ত করলো। আমরা বসলাম।
নবীজি (সা.) আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং আমাদেরকে ডেকে পাঠালেন। আমাদের দিকে দৃষ্টি দিলেন এবং বললেন ‘তোমাদের মাঝে নেতা কে?’ আমরা সকলে মুনজির ইবন আয়িজের দিকে ইংগিত করলাম। তিনি বললেন, ‘এই আল-আশাজ (কপাল পাটা)! এটাই প্রথম দিন তাকে এই নামে ডাকা হলো। গাধার খুরের আঘাতে তার মুখে পাটা সৃষ্টি হয়েছিলো। আমরা বললাম, হ্যাঁ! হে আল্লাহর রাসূল (সা.)।
কিন্তু আশাজ জনতার থেকে কিছুটা দূরে ছিলো; সে সবার বাহনগুলো বাধঁছিলো এবং সবার আসবাবপত্র গোছাচ্ছিলো; তারপর সে মুখের কাপড় সরালো এবং ভ্রমণের পোশাক ছেড়ে উত্তম কাপড় পরিধান করলো। তারপর নবীজির (সা.) দিকে এগিয়ে আসলো। নবীজি (সা.) পা বিছিয়ে হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। আল-আশাজ নবীজির (সা.) কাছাকাছি আসলে জনতা তার জন্য স্থান প্রশস্ত করলো। সবাই সমস্বরে বললেন, ‘এ দিকে, হে আশাজ!’ নবীজি (সা.) পা টেনে সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, ‘এ দিকে, হে আশাজ!’
তিনি নবীজির (সা.) ডান পাশে বসলেন। নবীজি (সা.) তাকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং উষ্ণতা বিনিময় করলেন। তার দেশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন এবং একটির পর একটি জনপদের নাম নিচ্ছিলেন! আল-সাফা! আল-মুশাক্কার! এ ছাড়া হাজারের আরো অনেক গ্রাম! বিস্মিত হয়ে আশাজ বললেন, কী ব্যাপার! আমার মাতা-পিতা উৎসর্গ হোক, হে রাসূল! আমাদের জনপদের নামগুলো দেখছি আপনি আমাদের চেয়েও বেশী জানেন! তিনি (সা.) জবাব দিলেন, ‘আমি তোমাদের দেশ বহুবার ভ্রমণ করেছি এবং তা আমার সুস্পষ্ট জানা…।’
বর্ণনার এ পর্যায়ে একটি বিরতি টেনে আমরা হাদীসে উল্লেখিত স্থানের সনাক্তকরণ পর্যালোচনা শুরু করতে পারি। সীরাতের গ্রন্থাবলীতে আছে যে, নবীজি (সা.) আবদুল কাইস গোত্রের প্রতিনিধি দলটির সাথে উক্ত সংলাপটি করেছিলেন মদীনায়। তারা সংখ্যায় ছিলেন তের বা চৌদ্দ জন। হিজরতের পঞ্চম বছর কিংবা তারও পূর্বে তারা মদীনায় আসেন [আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতু রাসূলিল্লাহ]।
সংলাপটির প্রারম্ভে প্রসঙ্গক্রমে নবীজি (সা.) তাদের দেশ ভ্রমণের স্মৃতি উল্লেখ করেন। ‘হাজার’-এর দু’টি গ্রাম: একটি ‘আল-মুশাক্কার’ ও অন্যটি ‘আল-সাফা’। হাদীসে হাজারের আরও কিছু স্থান বললেও বর্ণনাকারী সুনির্দিষ্ট কোনো নাম উল্লেখ করেননি। বর্ণনাকারীকে পাশ থেকে ‘উবাইদুল্লাহ ইবন আবি জারওয়াহ’ একটি বাক্য মনে করিয়ে দেন, ‘আমি জারারার ঝর্ণায় দাঁড়িয়ে ছিলাম’ [মুসনাদ আহমদ, ১৭৪৮১]।
সেই ঝর্ণাটি সম্পর্কে সংলাপটির অন্য একটি বর্ণনায় নবীজির (সা.) স্বশরীরে সে স্থান পরিভ্রমণের বাস্তব অভিজ্ঞতা হাজির করে।
“আমি জানি না হাজারের কোন জায়গা শ্রেষ্ঠ? বললো, ‘আজ-জারাহ’। নবীজি (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি তাতে অবশ্য প্রবেশ করেছি এবং জারারার ঝর্ণায় আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেখানে পাথর থেকে পানি প্রবাহিত হয়।” [ইতহাফুল খাইরাহ, ৩০৩৩]
নবীজির (সা.) সে অঞ্চল সম্পর্কে অগাধ জানা-শুনা দেখে আশাজ বিস্মিত হয়েছিলো। তার মুখ দিয়ে বিস্ময় ঝরে পড়লো, ‘আপনি দেখি আমাদের থেকেও আমাদের জনপদ সম্পর্কে বেশি জানেন!’ এটা একজন স্বদেশী কখন বলেন?
আবদুল কাইস গোত্রের কাফিলাটি মদীনা থেকে ফিরে যাওয়ার পর নিজ এলাকায় একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে তাতে জুমা আদায় শুরু হয়। ইসলামের ইতিহাসে মদীনার বাইরে এটাই প্রথম জুমা মসজিদ। সে ঘটনায়ও একটি স্থানের উল্লেখ আছে যা নবীজির (সা.) ভ্রমণের স্থানটি সনাক্তকরণের উপাদান হতে পারে।
“ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই ইসলামে মদীনায় মসজিদে নববীর পর প্রথম জুমার অনুষ্ঠিত হয় ‘জুআসা’তে-যা বাহরাইনের একটি গ্রাম। উসমান বলেন, এটি আবদুল কায়িস গোত্রের জনপদগুলোর একটি।” [বুখারী, ৮৪৮; আবূ দাউদ, ৯০৪]।
পাঠক, আমরা আশাজের সংলাপটি শেষ করিনি! সে সংলাপটিতে ফিরবার পূর্বে হাজার, মুশাক্কার, সাফা, জারারাহ এবং জুআসা এ পাঁচটি স্থানের পরিচিতি আলোচনা করা যায়।
এক. হাজার: এটি বাহরাইনের প্রধান শহর। বলা হয়, ‘বাহরাইনের সকল প্রান্ত-ই হাজার’ [মুজাম বুলদান]। ‘আরব আল-মুসতারিবার কোন এক নারী ‘হাজার বিন মুলাফ্ফাফ’-এর নামে একে ‘হাজার’ বলা হয়। ঐ নারীর স্বামী মুহাল্লাম ইবন আবদিল্লাহর নামে বাহরাইনের নদী ও ঝর্ণা ‘নাহর মুহাল্লাম’ ও ‘আইন মুহাল্লাম’ নামে অভিহিত হয়ে আসছে [ইবনুল কালবী]।
হাজার এমন একটি দেশ যার একটি শহর ‘আল-সাফা’; হাজারের থেকে উটে চড়ে ইয়ামামার দূরুত্ব দশ দিন এবং বসরার দূরুত্ব পনের দিন [আল-মাওয়ার্দি, আল-হাবী]
সাদ জুনাইদাল বলেন, ‘হাজার আরব উপদ্বীপের পূর্বাঞ্চলে আহসা জেলার পুরনো নাম। এখনো কেউ কেউ তাকে হাজার নামে অভিহিত করে। ফলে তা হাজার ও আহসা দুটি নামে-ই পরিচিত। ‘আল-হুফুফ’ তার অংশ। দেশটি ছিলো খেজুরের জন্য প্রাচুর্য্যময়; ছিলো বাণিজ্যিক বাজার; তাতে প্রতিষ্ঠিত প্রসিদ্ধ শিল্প ছিলো তৈরি পোশাক (কাপড়ের উপর রেশমি সেলাই), বকরী পশম প্রক্রিয়াজাতকরণ, পাথুরে বালি-কাদার হস্তশিল্প এবং খেজুরের পাতাজাত পণ্য শিল্পের জন্য খ্যাত। জায়গাটি ছিলো বাহরাইন অঞ্চলে যা আজকের সৌদির পূর্বাঞ্চলীয় জেলার আল-আহসা; আহসার রয়েছে ঐতিহাসিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক প্রসিদ্ধি ও ঐতিহ্য [মুজাম আল-আমকিনা, ৪৪৯]
প্রিয় পাঠক, কী সে ঐতিহ্য! যা নবী জীবনের অংশ হয়ে আছে? নবীজির (সা.) মক্কা জীবনের কথার মাঝে ‘হাজার’ প্রসঙ্গের উপস্থিতি কী প্রমাণ করে? আসুন সেটা আলাপ করা যাক-
কাবার দেয়ালে হেলান দিয়ে নবীজি (সা.) তাঁর মিরাজের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। সিদরাতুল মুনতাহার বিষয় আসলো। গাছটির পাতার সাদৃশ্য দিলেন “তার ফল যেন ‘হাজার’ নামক স্থানের মটকার মতো’ [বুখারী, ৩৬২৩]।
সীরাতকারগণ নবীজির এ অভিজ্ঞতার বিষয়ে নিরব! দুয়েকটি দূর্বল ব্যাখ্যায় দেখা যায় বলার চেষ্ঠা করা হয়েছে যে, হাজার থেকে সে সমস্ত মটকা মদীনায় আনা হয়েছিলো কিংবা মদীনায় হাজারের মটকার সদৃশ মটকা তৈরি করা হতো। [আল-মাওয়ার্দি, আল-হাবী]; কিন্ত ঘটনাতো মাক্কী জীবনে! হয়তো সীরাতকারগণ নবীজির হাজার ভ্রমণের বিষয়টি কখনো ভাবেননি; হয়তো সীরাতের অধিকাংশ ওয়াকিদীর অনুসরণের ফলে ভিন্ন কিছু খুঁজে দেখার দায়িত্ব নেননি। ফলে সীরাতের কিতাবগুলোতে নবীজির বিশ বছর বয়স থেকে পয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত কাবা ঘর নির্মাণে অংশগ্রহণ, বুসরায় খাদিজার ব্যবসা পরিচালনা ও বিয়ে ছাড়া আর কোনো ঘটনা নেই!
নবীজিকে (সা.) হিজরতের ভূমি স্বপ্নে দেখানো হয়েছিলো, সে বর্ণনা হাদীসের কিতাবে রয়েছে। নবীজি (সা.) স্বপ্নের সে-ই জায়গাটিকে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে যে কয়টি স্থান হতে পারে কল্পনা করলেন তার মধ্যে একটি ‘হাজার’!
“আবূ মূসা আল-আশআরী থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বললেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখলাম যে আমি মক্কা থেকে এমন একটি ভূমিতে হিজরত করছি, যাতে রয়েছে খেজুরের বাগান। আমার ধারণা হলো যে, তা আল-ইয়ামামা কিংবা হাজার। তারপর বাস্তবে তা হয়েছে মদীনা ইয়াসরিব’ [বুখারী, ৩৩৭৫]
কেন নবীজির (সা.) ধারণায় ‘হাজার’ এসেছিলো? নবীজির কী সে-ই শহরটি পূর্বে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো?
দুই. মুশাক্কার: এটি বাহরাইনের একটি দূর্গ [মুজাম আল-বুলদান]। এটি বাহরাইনে আবদুল কাইসের দুর্গ [আল-বাগদাদী]। আল-মুশাক্কার একটি বড়ো শহর যার মাঝখানে একটি দূর্গ আছে [ইবনুল আরাবী]। আল-মুশাক্কার হাজারের একটি গ্রাম। হাজার বাহরাইনের একটি শহর। আল-মুশাক্কারে ইসলাম পূর্ব সময়ে পারস্য শাসনামলে বানানো একটি দূর্গ রয়েছে যা তারা গ্রামের সুরক্ষায় তৈরি করেছিলো [হামদ আল-জাসির, আল-জুনুব আশ-শারকিয়্যাহ]।
আল-মুশাক্কার গ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ‘জাবাল আল-মুশাক্কার’ তথা মুশাক্কার পাহাড়। পাহাড়ের উপর নির্মিত হয়েছে সে দূর্গ। ফলে এক সময় গ্রামের চেয়েও বাড়তে থাকে দূর্গের প্রসিদ্ধি। স্থানটির নতুন নতুন নাম যোগ হতে থাকে। রা’স আল-জাবাল আল-মুশাক্কার! তারপর রা’স আল-কারা! তারপর আল-কারা! তবুও এখন পর্যন্ত হাজারের গ্রামটি ‘আল-মুশাক্কার’ নামেও পরিচিতি ধরে রেখেছে [আবদুল খালিক আল-জানবি, হাজার ওয়া কাসবাতিহা আস-সালাস]। সৌদির পূর্বাঞ্চলীয় বর্তমান ‘আল-হুফূফ’ শহরের পূর্বে ‘কারিয়া আল-কারা’ নামে তা এখনো বিদ্যমান।
আল-মুশাক্কার দু’টি কারণে জাহিলী যুগ থেকে বিখ্যাত। একটি ‘আইনুল মুশাক্কার’ বা মুশাক্কার ঝর্ণা। বর্তমানে তা ‘আইনুল খাসীফ’ নামে পরিচিত। পুরো হাজারের মিষ্টি পানির পর্যাপ্ততার পাশাপাশি আইনুল মুশাক্কারের উপস্থিতি আরবদেরকে স্থানটির কাছে টেনে নেয়। আরেকটি ‘সূকুল মুশাক্কার’ বা মুশাক্কার বাজার। প্রতিবছর জুমাদাল আখিরার প্রথম থেকে এখানে বাজার বসতো। দুমাতুল জান্দাল, ওমান, ইয়ামেন এমনকি পারস্য সম্রাটের পক্ষ থেকে ব্যবসায়িক কাফিলা আসতো এ বাজারে। কাপড়, খেজুর, যুদ্ধের সরঞ্জাম বাণিজ্যের জন্য এটি আরবের বিখ্যাত বাজার। বাজারের রীতি-নীতি ছিলো সুস্পষ্ট। ক্রয়-বিক্রয়ের মুলামাসা, আল-ইমা ও আল-হামহামা পদ্ধতি এখানে-ই প্রচলিত ছিলো।
পণ্য বিক্রয় শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাজার বন্ধ করা রীতি বহির্ভূত ছিলো। এটাই ছিলো আরবদের পূর্বাঞ্চলীয় বাজার ‘সূকু হাজার’ তথা ‘হাজারের বাজার’। প্রাচীন আরবের ‘তারীকুল কাওয়াফিল’ তথা বাণিজ্যিক দলের যে পথ ছিলো তার পূর্বাঞ্চলীয় শেষ সীমান্ত ছিলো এ বাজার। খুব সম্ভবত প্রাচ্যের ভারতবর্ষ ও চীনের দেশগুলোর সাথে এ পথে আরবদের যোগাযোগ ছিলো। [আলূকাডটনেটকম অবলম্বনে]
তিন. সাফা: এটি বাহরাইনের একটি দূর্গ [মুজামুল বুলদান]। তা হাজারের একটি শহর [ইবনুল ফাকীহ]। আল-মুশাক্কারের পাশে হাজারের আরেকটি গ্রাম ‘আল-সাফা’। দু’টি গ্রামের মাঝখানে বিখ্যাত নদী ‘আল-মুহাল্লাম’ প্রবাহিত যা নিয়ে কবি ইমরুল কাইস কবিতা রচনা করেছেন। সাফায় রয়েছে আরেকটি দূর্গ যা ‘হিসনুস সাফা’ নামে পরিচিতি। হিসনুস সাফা দূর্গ আরবের বিখ্যাত কবি ‘তুরাফা ইবনুল আব্দ’-এর হত্যাকাণ্ডের জন্য পরিচিতি পায়। আল-মুশাক্কার আর আল-সাফার মাঝে খুব সম্ভবত কোনো পার্থক্য ছিলো না বৈশিষ্টগত দিকে থেকে। কারণ সাফাতেও ঝর্ণা এবং দূর্গ ছিলো। হাজারের ‘জাবালু সাফা’ পৃথিবীর যে কোনো পাহাড়ের তুলনায় অনন্য। পাহাড়টি খুব উচু না হলেও পুরো পাহাড়টি যেন অনেকগুলো যাত্রী চাউনি কিংবা বিশ্রামাগার। মরুভূমিতে তা যেন একটি নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ তৈরি করে।
নবীজির (সা.) কাছে বাহরাইনের কিছু অতিথি আসলে তিনি তাদের উপদেশ দিতে গিয়ে যে উপমা ব্যবহার করেন তাতে এ আল-সাফার অভিজ্ঞতা-ই কাজে লাগিয়েছেন বলে প্রতিভাত হয়। নবীজি (সা.) বলেন, “প্রতিবেশিকে কষ্ট দেয়া সৎকর্মকে সেভাবে নিশ্চিহৃ করে যেভাবে সূর্য ‘আল-সাফা’র আদ্রতাকে মিটিয়ে দেয়’ [সিলসিলাতুস আহাদীস আস-সহীহা, ২৯৯৮;আস-সামিন আশারা মিনাল খালিয়াত]
চার. আজ-জারাহ: এটি বাহরাইনের একটি বড়ো গ্রাম যেখানে ‘মারযাবানু জারাহ অবস্থিত [মুজামুল বুলদান]। জারাহ বাহরাইনে অবস্থিত, তাতে রয়েছে প্রসিদ্ধ ঝর্ণা [আল-কামূস আল-মুহিত]। ‘আইনু জারাহ’ তথা জারার ঝর্ণা বাহরাইনে প্রসিদ্ধ-যা অনেক বড়ো গ্রাম। তাতে রয়েছে মারযাবানু জারাহ; উপকূলীয় শহরটি খেজুর ও মাছের জন্য বিখ্যাত [আল-মাসালিক ওয়াল মামালিক]।
এটি সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় ‘আল-আওয়ামিয়া’র উত্তরে অবস্থিত আল-কাতিফের প্রাচীন গ্রামগুলির একটি। এটি প্রাচীন বাহরাইনের রাজধানী। গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি পাহাড় আছে যার নাম ‘আল-হারীফ’। জাবালু হারীফের অন্যন্য বৈশিষ্ট্য ‘আইনু জারাহ’ যা এখন ‘আইনু হারীফ’ নামে পরিচিত। তারপর ‘সূকুল জারাহ’ তথা আল-জারার বাজার। এটি ‘আল-মুশাক্কারের বাজারের কাছাকাছি। দুটি বাজার-ই তারীকুল কাওয়াফিলের পাশে যা সেখানে ‘তারীকুল বাখুর’ তথা ‘সুগন্ধির পথ’ হিসেবে পরিচিত ছিলো।
পারস্য উপসাগর হয়ে এ পথে ভারত ও চীনের মতো দূর প্রাচ্যের সুগন্ধি পৌঁছে যেতো ইয়ামেন আল-সাঈদ তথা ‘সৌভাগ্যের ইয়েমেন’-এ! নবীজি (সা.) ‘আইনু জারাহ-তে পদার্পণ করেছিলেন! এ অঞ্চলের শতাধিক ঝর্ণার প্রসবণ বন্ধ হলেও সে-ই ঝর্ণাটি কখনো বন্ধ হয়নি! সুবহানাল্লাহ।
পাঁচ. জুআসা: ‘জুআসা’ বাহরাইনের গ্রামগুলোর একটি-যা আবদুল কাইসের এলাকা [ইবন হাজার, ফাতহুল বারী; আল-বাকরি, মুজাম মা]। এটি বাহরাইনে আবদুল কাইস গোত্রের দূর্গ [ইয়াকূত আল-হামাভী, মুজামুল বুলদান]। এটি ‘আহসা মরুদ্যানে অবস্থিত। ‘আল-খাত’ হচ্ছে কাতীফ ও তার আশপাশ [হামদ আল-জাসির, আল-জুনুব আশ-শারকিয়্যাহ]।
আহসার প্রান্তসীমায় গ্রামগুলোর মাঝে অপেক্ষাকৃত উচু গ্রামটি ‘জুআসা’। উচ্চতার কারণে পূর্ববর্তী-পরবর্তীদের অনেকে এটাকে দুর্গ বিবেচনা করেন। ‘জুআসা’ এখনো একই নামে বিদ্যমান আছে। স্থানটি ‘আল-মুবাররাজ’ শহরের পূর্বদিকে তিন ঘন্টা হাটার দূরুত্বে অবস্থিত। [সাদ জুনাইদাল, মুজাম আল-আমকিনাহ, ১৫৫]
পাঠক, আশা করি নবীজির (সা.) স্মৃতি বিজড়িত ‘হাজারের স্থানগুলো আপনি সনাক্ত করতে পেরেছেন। চাচা আবু তালিবের সাথে নবীজি (সা.) ব্যবসায়িক কাজে হাজারের এ গ্ৰামগুলোতে গিয়েছিলেন। নবী জীবনের পূর্বাপর ঘটনা এমনটায় দাবি করে।
আসুন আল-আশাজের সংলাপে ফিরে যাই।
“……. তারপর তিনি আনসারদের কাছে আসেন এবং বলেন, ‘হে আনসারগণ! তোমাদের ভাইদের মর্যাদা করো। তারা ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে অনুভূতি ও আবেগের দিক থেকে তোমাদের সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ; তারা চাপ অবাধ্যতা ছাড়া-ই স্বচ্ছন্দে এমন সময়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে, যখন লোকেরা যুদ্ধ ছাড়া ইসলাম গ্রহণ অস্বীকার করছে।…….”
এ তথ্যটি তাদের আত্মপরিচয় বহন করে। তাদের সাথে মদীনার আনসারদের মিল হচ্ছে, তারা কেবল দাওয়াতের মাধ্যমে-ই ইসলাম গ্রহণ করেছে। তারপর কাফিলা রামলা বিনতে হারিসের (রা.) গৃহে রাত্রি যাপন করে। ফজরের সালাতের পর সবাই মসজিদে নববীতে সমবেত হয়।
“……..পরদিন সকাল বেলা নবীজি (সা.) বললেন, ‘তোমাদের ভাইদের তোমাদের প্রতি মর্যাদা ও আতিথিয়তা কেমন দেখলে?’ তারা উত্তর দিলেন, ‘উত্তম ভ্রাতা’; তারা আমাদের নরম বিছানা দিয়েছেন এবং উত্তম খাবার সরবরাহ করেছেন; রাত-ভোর আমাদেরকে আমাদের রবের কিতাব আর নবীর সুন্নাহ শিক্ষা দিয়েছেন।’ নবীজি (সা.) বিস্মিত হলেন এবং আনন্দ প্রকাশ করলেন। তারপর আমাদের প্রত্যেকের সাথে একেক করে মিলিত হলেন এবং আমরা যা যা শিখলাম-জানলাম তা উপস্থাপন করলাম। আমাদের কেউ তাহিয়্যাত, কেউ তিলাওয়াত, কেউ একটি বা দু’টি সূরা কিংবা সুন্নাত শিখে নিয়েছিলাম। তারপর তিনি আমাদের সবার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন।……..[মুসনাদ আহমদ, ১৫১৩১]
পাঠক, সংলাপটি এখানেও শেষ নয়! নবীজির (সা.) সাথে তাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আলাপচারিতায় খেজুরের প্রসঙ্গ উঠে আসে। নবীজি (সা.) তাদের বহন করে নিয়ে আসা হরেক রকম খেজুরের নাম ও গুণাগুন বলে দিচ্ছেন! তারপর খেজুরের রস নিংড়ানোর চারটি পাত্রের নাম এবং তাতে রস নিংড়ানো নিষিদ্ধ করে দেন। সংলাপটিতে মনোযোগ দিলে নবীজির (সা.) সে এলাকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পেয়ে যাবেন। এতো দীর্ঘ সংলাপটি আর আলোচনা করা গেলো না। নবী জীবনে সম্ভবত বাহরাইনের প্রতিনিধির সাথে সংলাপটিই সবচেয়ে দীর্ঘ! কেন হবে না? তাদের সে অধিকার প্রাপ্য ছিলো। তারাও ছিলেন বাগ্নী। তাদের-ই এক লোকের বক্তৃতা শুনে সাহাবীরা সবাই বিস্মিত হয়ে যান।
তারপর নবীজি (সা.) তাদের জন্য দুআ করেন। প্রতিনিধি দল ফিরে যায় বাহরাইন। এদিকে হুদাইবিয়ার চুক্তি পর নবীজি (সা.) বিশ্বের দিকে দিকে দাওয়াতি মিশন পাঠাচ্ছেন। তিনি আল-আলা ইবন আল-হাদরামীর (রা.) মাধ্যমে পত্র পাঠালেন বাহরাইনের শাসক ‘মুনজির ইবন সাওয়া’-এর নিকট। তাকে অনুসরণ করে আবূ হুরাইয়ারও (রা.) যান বাহরাইনে। মুনজির ও তার অধিনস্তরা ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু রাজ্যে বসবাসকারী ইহুদী ও খ্রিস্টানদের কিছু পাদ্রী ইসলাম কবুল করেনি। করণীয় প্রসঙ্গে নবীজিকে তিনি পত্র দিলেন। মদীনায় পত্র এলো আবার পত্র গেলো বাহরাইন। পাদ্রীদের সাথে জিজিয়া চুক্তি হয়েছিলো।
তারপর নবীজি (সা.) আরেক পত্র বাহক আবদুল্লাহ ইবন হুযাফা আস-সাহমীকে (রা.) পাঠান বাহরাইনে। চিঠি মুনযির ইবন সাওয়া হয়ে যাবে পারস্যের অধিপতি কিসরার নিকট। পারস্যের দরবারে সে চিঠি পৌঁছালে তা দুমঢ়ে মুচড়ে দেয়া হয়। নবীজির নিকট সে সংবাদ পৌঁছে মদীনায়। কষ্টের হাত উঠে আরশে দিকে। দুমড়ে যায় পারস্যে সাম্রাজ্য।
তারপর নবীজি (সা.) আবূ উবাদাহ ইবনুল জাররাকে (রা.) পাঠালেন বাহরাইন। মদীনায় এক রাতে তিনি পৌঁছালেন আশি হাজার স্বর্ণ মুদ্রা নিয়ে। তারপর সুবহে সাদিক হলো। মসজিদে নববীর দরজায় সমবেত জনতাকে দেখে মুচকি হাসছেন রাসূল আল-আরাবী (সা.)। সবার অপেক্ষা কাকে কী দিবেন? অঞ্জলী ভরে যার যা খুঁশি নিতে বললেন নবীজি! আব্বাস (রা.) সেদিন আক্বিলের ঋণ পরিশোধের বিষয় উঠালেন। নবীজি যা ইচ্ছা নেয়ার অনুমতি দিলেন চাচাকে। তিনি পাত্রে এতো পরিমাণ ভরলেন যে তুলতে পারছিলেন না! বোঝা তুলে দিতে গিয়ে নবীজির (সা.) মুচকি হাসলেন।
তারপর সময় গড়িয়ে নবম হিজরী সন উপস্থিত। নবীজির বার্তা গেলো বাহরাইনে ‘বিশ জনের কাফিলা’ যেন মদীনায় আসে! কাফিলা আসলো মদীনায়। সাথে এক খ্রিষ্টান পাদ্রী। তার নাম ‘জারুদ’ যার ইসলাম গ্রহণ সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছিলো। কথাবার্তা শেষে নবীজি ‘আলা আল-হাদরামীকে পরিবর্তন করে ‘আবান ইবন সাঈদ ইবন আল-আস’কে (রা.) নিয়োগ দিলেন বাহরাইনে।
জারুদের কাফিলা ফিরে যাচ্ছে বাহরাইন। নবীজি (সা.) মুনজির ইবন আয়াজ আল-আশাজের দু’টি গুণ তুলে ধরে তাঁর উন্নত ব্যক্তিত্বের উচ্চসিত প্রশংসা করলেন! মুনকিয ইবন হাইয়্যানের (রা.) মুখ মুছে দিলেন নিজ হাতে! কী বিয়োগান্ত দৃশ্য ছিলো সে বিদায়! শত বছর পর সিরিয়ার হালব শহরে বসে মৃত্যুর বিছানায় সে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন আরেক সাহাবী নাফি আল-আবদি তাঁর পুত্র সুলাইমানকে!
তারপর নবীজি (সা.) ‘আমর ইবন আসকে (রা.) পাঠালেন বাহরাইনে। সেখানে এক পাদ্রীর কাছে তিনি সংবাদ পান মদীনায় নবী শুন্য হওয়ার সংবাদ!
নবীজির ইন্তিকালের অল্পসময়ের মাঝে বাহরাইন সম্রাট ‘মুনজির ইবন সাওয়া’ (রা.) মৃত্যুবরণ করেন। তারপর খিলাফতের শুরুতে চারদিকে বিদ্রোহ! খলিফা আবূ বকরের (রা.) পত্র নিয়ে বাহরাইনে উপস্থিত সাহাবী আনাস ইবন মালিক (রা.)। প্রান্তে প্রান্তে বিদ্রোহ! বাহরাইনে ইহুদী আর খ্রিষ্টানদের বিদ্রোহ। মুসলিমরা বিভ্রান্ত। কিন্তু সে জুআসা ও জারুদের কাফিলার ইসলাম গ্রহণের সৌন্দর্য প্রস্ফোটিত হলো। জারুদ এক যৌক্তিক জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন জুআসার মিম্বরে। সাহাবীদের একটি কাফিলা সত্যের উপর দাঁড়িয়ে গেলেন।
বিদ্রোহীরা মসজিদে তাদের অবরুদ্ধ করলো। সাহাবীদের অনেকে শহীদ হলেন। সাহাবী আবান ইবন সাঈদ (রা.) ফিরে এলেন মদীনায়। তিনি আর সে দায়িত্বে ফিরবেন না!
আবূ বকর (রা.) আবার আল-আলা ইবন আল-হাদরামীকে (রা.) পাঠালেন বাহরাইনে। ইতোমধ্যে তরবারী হাতে বাইরাইন সীমান্তে প্রবেশ করেছে খালিদ ইবন ওয়ালিদ (রা.)। তারপর বিজয়ের ইতিহাস। স্থলের সীমানা ছাড়িয়ে পারস্য উপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের উপর দিয়ে পারস্যে প্রবেশ করেছে সম্মুখে ধাবমান উটের আরোহিরা! আবূ হুরাইরা (রা.) বলছেন, ইবনুল হাদরামীর এ কাণ্ডের কোনো ব্যাখ্যা নেই! তিনি নিজেও ছিলেন কাফিলায়। তারমধ্যে মদীনার থেকে খলিফার মৃত্যু সংবাদ!
তারপর খলিফা ওমরের (রা.) খিলাফতের অল্প কিছু দিনের মাঝে আলা আল-হাদরামী (রা.) চিরবিদায় নেন। তারপর খলীফা বদরী সাহাবী ‘কুদামা ইবন মাজউনকে (রা.) গভর্ণর করেন। তারপর ‘আবূ হুরাইরা (রা.) বাহরাইনের গভর্ণরের দায়িত্বে আসেন। মদীনায় আবার বিস্ময়কর পরিমাণ সম্পদ আসে বাহরাইন থেকে। বাহরাইনে ব্যবসা করেন আবূ হুরাইরা (রা.)। আম্মাজান আয়িশার (রা.) ব্যবসায়িক কাফিলাও গিয়েছে বাহরাইনে। কী গুরুত্ব না-ই ছিলো বাহরাইনের! নবীজির হাজারের!
তারপর উসমান (রা.)-এর সময়েও গুরুত্ব ছিলো শহরটির। কুরআনের বিশুদ্ধ সাতটি কপির একটি গিয়েছিলো সে জুআসায়। তারপর ধীরে ধীরে শহরগুলোর ম্লান হওয়ার ইতিহাস। করুণ পরিণতি। এক সময় কারামিয়া সম্প্রদায় দখলে নেয় জুআসার। দখল হয়ে যায় মসজিদের মিম্বর! কাবার হাজর আসওয়াদ নিয়ে লুকিয়ে রাখে জুআসার মসজিদে!
তারপর ধীরে ধীরে ছায়া নামে জুআসায়!
দেশি-বিদেশির আনাগোনা কমে যায় আল-সাফা আর আল-মুশাক্কারের বাজারে!
রাজধানীর মর্যাদার হারায় আল-জারাহ!
তবু কালের কাছে হারে না আইনু জারাহ!
রাসূলুল্লাহর মর্যাদা কতো মহান!
দুনিয়াতে তাঁর মর্যাদা কতো সুউচ্চে!
একটি স্পর্শের কারণে আইনুজ জারাহ সদা প্রবাহমান! কখনো কী আইনু জারাহর জল আমাদের পা ছুঁয়ে যাবে? অঞ্জলী ভরে এতটুকু কী পানি কি হৃদয়ের পিপাসা মিটাতে পারবো? সে আশা পুরণ হলে-ই কি না-হলে কি! নবীজি (সা.) আখিরাতে থাকবেন আল-কাওসারের নিকট! সেদিন তিনি পিপাসা মিটাতে পান করাবেন হাওদ আল-কাওসারের শারাবান তাহুরা। তাঁর প্রতি মহব্বতের পিপাসা মিটাবেন কীভাবে?
-সোহবত, হে আল্লাহ!
-সোহবত, হে প্রভু!
নবীয়্যিন, সিদ্দিকীন, শুহাদা, সালেহীনদের সোহবত।
আমাদেরকে জান্নাতে নবীজির সান্নিধ্যে রেখো। হে রব!
সাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মদ
Tags: নবিজীর ব্যবসায়িক জীবন, মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক, সিরাত, সীরাত, সীরাতে রাসুল (সঃ)
Rent for add