নুর উল্লাহ কায়সার, ফেনী : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার, ১৬:০৬:৪৮
রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে খননকৃত নবাব শমসের গাজীর অস্ত্র ভান্ডার নামক খ্যাত একখুইল্লা দিঘি…
ভাটির বাঘ নামে খ্যাত শমসের গাজীর ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত প্রায়। তিন ’শ বছরের পুরোনো এসব ঐতিহ্য দেখতে এখনো শতশত দর্শনার্থী ছুটে আসেন শমসের গাজীর প্রধান কেল্লা ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার জগন্নাথ-সোনাপুর ও চম্পক নগরের মাঝামাঝি রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে।
সেখানে পাহাড়ের চূড়ায় শমসের গাজীর সামরিক প্যারেড, সমরাস্ত্র ভান্ডার একখুইল্লা দিঘী, সুড়ঙ্গ পথ ও বিশেষ মাটির সুরক্ষার ডুগডুগি নানা কৌতুহল জাগিয়ে তোলে দর্শনার্থীদের মনে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম শমসের গাজীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস পৌঁছে দিতে ওই এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে নবাব শমসের গাজী হাফেজিয়া মাদ্রাসা, শমসের গাজীর বাঁশের কেল্লা রিসোর্টসহ নানা প্রতিষ্ঠান।
রঘুনন্দন পাহাড়ের থেকে নর্দমা দিঘী পর্যন্ত তৈরী করা ঐতিহাসিক সুড়ঙ্গ পথ।
কিন্তু এসবের মাঝে রাষ্ট্রীয় কোন পৃষ্ঠপোষকতা নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের লালন ও শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়ার দাবী করেছেন শমসের গাজীর উত্তরসূরী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা।
ইতিহাস ও শমসের গাজীর সপ্তম উত্তরসূরীদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে ছাগলনাইয়া উপজেলার নিজকুঞ্জরা এলাকার দানশীল ব্যক্তি নাসির মন চৌধূরীর আশ্রিত পীর মোহাম্মদ এবং কৈয়ারা বেগমের সংসারে জন্ম হয় শমসের গাজীর। অল্পবয়সে বাবাকে হারানো অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা বালক শমসের শৈশবেই বৈচিত্রময় দুরন্তপনার অধিকারী ছিলেন।
ভবঘুরে বালক খাদ্যের সন্ধানে দিগবিদিক ছুটে চলা শমসের একদিন শুভপুরের তালুকদারের নজরে পড়েন। শমসেরের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে নিঃসন্তান তালুকদার জগন্নাথ সেন ও তার স্ত্রী সোনা দেবী তাকে দরবারে থাকার সুযোগ করে দেন। তালুকদার দম্পতির স্নেহ-মমতায় বড় হওয়ার পাশাপাশি লেখাপড়াসহ তলোয়ার, লাঠি, কুস্তি, তীর-ধনুক চালনায় পারদর্শিতা লাভ করে একেরপর এক দক্ষতার পরিচয় দিতে থাকেন শমসের।
স্থানীয় জগন্নাথ সোনাপুরে স্থাপিত নবাব শমসের গাজী বাঁশের কেল্লা রিসোর্ট।
এক পর্যায়ে জমিদার জগন্নাথ সেন শমসের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তাকে পানুয়াঘাট কেল্লার অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। মূলত এখান থেকেই শুরু হয় শমসের গাজীর উত্থানের গল্প।
তৎকালীন সময়ে দক্ষিণ বাংলার এ অঞ্চলটি মগ, পর্তুগিজ, হার্মাদ জলদস্যুদের কাছে জিম্মি ছিলো। ওই সময়ে প্রায় অর্ধ সহস্র সদস্যের সমন্বয়ে পানুয়াঘাট এলাকায় একটি শক্তিশালী দস্যুর রাজত্ব ছিলো। শমসের গাজী অধ্যক্ষের দায়িত্ব পেয়েই কঠোর হস্তে দস্যুদের বিতাড়ন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে চতুর্দিকে সুনাম ছড়িয়ে দেন।
তালুকদার জগন্নাথ সেনের মৃত্যুর পর শমসের খাজনা আদায় শুরু করেন। ১৭৩৯ সালের দিকে ত্রিপুরার মহারাজের সেনাপতি শমসেরের এলাকায় প্রবেশ করলে তাদেরকে প্রতিরোধ করে বন্দি করা হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে তৎকালীন ত্রিপুরার মহারাজ তার সেনাপতির মুক্তির শর্তে গাজীকে জমিদার হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
স্থানীয় জগন্নাথ সোনাপুরে স্থাপিত নবাব শমসের গাজী বাঁশের কেল্লা রিসোর্ট।
কয়েক বছরের মাথায় পাহাড়ি ঢলে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে শমসের কৃষকদের উপর এক বছরের খাজনা মওকুফ ও তিন বছরের খাজনা মহারাজের কোষে জমা না দেয়ার ঘোষণা দেন।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শমসেরকে উচ্ছেদ করার জন্য ত্রিপুরার মহারাজ ৭ হাজার সৈন্যবাহিনীর একটি দল পাঠায়। ওই সৈন্যদলকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন শমসের। খবর পেয়ে তৎকালীন ত্রিপুরার রাজা কৃষ্ণ মাণিক্য আগরতলা ছেড়ে মনিপুরের দিকে পালিয়ে যান। এতে ত্রিপুরা রাজ্যের বড় একটি অংশ শমসের গাজীর দখলে চলে আসে।
ওই সময়ে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরে হলেও তিনি বেশিরভাগ সময় ফেনী নদী বেষ্টিত জগন্নাথ-সোনাপুরস্থ চম্পকনগরের রঘুনাথ পাহাড়ের পাদদেশে স্থাপিত তার প্রধান কেল্লা ও প্রাসাদে থেকে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। নানারকম কৌশলে প্রজাদের বশে এনে দীর্ঘ একযুগ শমসের গাজী ত্রিপুরা শাসন কার্য পরিচালনা করে ইংরেজ বেনিয়াদের কোনঠাসা করে রাখেন।
রঘুনন্দন পাহাড়ের প্রবেশ ধারে ঝুলানো সাইন বোর্ড
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর মীর জাফর অথবা মীর কাশেমসহ ইংরেজ বেনিয়া, ত্রিপুরা থেকে বিতাড়িত মহারাজসহ অন্যরা একত্রিত হয়ে শমসের গাজীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ১৭৫৯ কিংবা ১৭৬১ সালের দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী এবং যুবরাজ কৃষ্ণমাণিক্যের নেতৃত্বে পাহাড়ী উপজাতীয় যৌথবাহিনী শমসের গাজীর কেল্লা ও উদয়পুরে আক্রমণ চালিয়ে গাজীকে পরাজিত ও আটক করে।
রাজমালা ও ত্রিপুরা রাজ্যের ইতিহাস গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, মুর্শিদাবাদের নবাব মীর জাফর বা মীর কাশেমের শাসনকালে এবং তাদের নির্দেশে শমসের গাজীকে হত্যা করা হয়।
রঘুনন্দন পাহাড়ের প্রবেশ ধারে ঝুলানো সাইন বোর্ড
তবে ইতিহাস ও সংশ্লিষ্ট নানা সূত্র বিশ্লেষণ করে শমসের গাজীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া গেলেও তার সপ্তম বংশধর এটিএম গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী জানান, ‘নবাব শমসের গাজীকে মুর্শিদাবাদে আলোচনার জন্য মীর জাফর আহবান করেন। শমসের গাজী স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের পথে রাওয়ানা হলে পথিমধ্যে তাদেরকে আটক করা হয়। আটকের পর শমসের গাজীকে হত্যা করা হবে বলে মীর জাফরের বাহিনী সকল রাজ্যে ঘোষণা পাঠায়। খবর পেয়ে শমসের গাজীর দ্বিতীয় স্ত্রী আখি রাণী সৈন্য সামান্ত নিয়ে ওই স্থানে হাজির হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এক পর্যায়ে তিনি সেখানে পরাজিত ও শমসের গাজীসহ নিহত হন।’
গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী আরও বলেন, ‘নবার সিরাজ-উদ দৌলার মৃত্যুর পর একই কায়দায় আলোচনার জন্য ঢেকে প্রতারণা করে ভাটির বাঘ শমসের গাজীকে হত্যা করে মীর জাফরের সৈন্যরা। শমসের গাজী ছিলেন সিরাজ-উদ দৌলার হত্যার পর দ্বিতীয় মুসলিম নবাব; যাকে ষড়যন্ত্র করে পরাজিত ও হত্যা করা হয়। শমসের গাজী ছিলেন ত্রিপুরার একমাত্র মুসলিম শাসক।’
নবাব শমসের গাজীর হাতে গড়া জামে মসজিদ
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র বলছে, প্রজাদরদী শমসের গাজীর শাসননামলের মাত্র এক যুগে তিনি অসংখ্য জনহিতকর ও প্রজাহিতকর কাজ করেছিলেন। তার সময়ে নির্মিত ফেনী নদীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এখনও ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে। এ ছাড়াও প্রজাদের পানীয়জলের সমস্যা লাঘব করতে তার মায়ের নামে কৈয়ারা দিঘি, তার মেয়ের নামে তনু বিবির দীঘি, বল্লভপুরের আলীয়া গাজীর দীঘি, বুড়া সামন্তের দীঘি, পূর্ব ছাগলনাইয়ার দেয়ান আব্দুর রাজ্জাকের দিঘি এখনো শমসের গাজীর জনহিতকর কাজের প্রমাণ বহন করে চলেছে।
তার সময়ে স্থাপিত জগন্নাথ-সোনাপুর জামে মসজিদ ও জগন্নাথ মন্দির এখনো শমসের গাজীর নাম প্রজন্মান্তরে স্বরণ করিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য হিন্দু-মুসলিম ধর্ম প্রচারককে তিনি অর্থ ও ভূমি দান করে উদারতার উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন।
নবাব শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত স্থানে গড়ে ওঠা মাদ্রাসা
নবাব শমসের গাজীর বংশধর এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী জানান, শমসের গাজীর রাজপ্রাসাদ ও কেল্লার সবচেয়ে বেশি অংশ বর্তমানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মাঝে পড়েছে। বাংলাদেশ অংশের রঘুনন্দন পাহাড়ে রয়েছে কেল্লার প্যারেড। যেখানে শমসের গাজীর সৈন্য-সামন্তরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেন। তার পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক একখুইল্লা দিঘি। কথির রয়েছে ওই দিঘীতেই শমসের গাজীর সামরিক অস্ত্রের ভান্ডার রক্ষিত ছিলো। ওই দিঘীর এপাশ থেকে ওপাশে ঢিল ছুড়ে কেউ পার করতে পারে না বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
পাহাড়টির পূর্ব পাড়ে রয়েছে শমসের গাজীর ঐতিহাসিক সুড়ঙ্গ পথ। সুড়ঙ্গ পথটি রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু হয়ে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নর্দমা দিঘির পাড়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। এটি মূলতঃ শমসের গাজীর ধর্মীয় চিন্তার একটি দর্শন। এ সুড়ঙ্গ পথে প্রবেশ করে রাজপ্রাসাদে থাকা নারীরা পর্দার সাথে দীঘিতে গিয়ে পরিচ্ছন্নতা ও শৌচকার্য করে পোশাক পরিধান শেষে রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করতেন।
তবে শমসের গাজীকে হত্যা করার পর ইংরেজরা নিজেদের ইচ্ছেমত ইতিহাস লিখে শমসের গাজীকে দস্যু, লুটেরা, লাঠিয়াল হিসেবে আখ্যা দেয়ার অপচেষ্টা করে। তখন ইংরেজদের ভয়ে কেউ সাহস করে সত্য লিখার অবস্থা না থাকলেও প্রকৃত সত্যটি কালক্রমে মানুষের সামনে চলে এসেছে। পৃথিবীর মানুষ ভাটির বাঘ খ্যাত শমসের গাজীকে প্রজাবান্দব শাসক খ্যাতিতেই ভূষিত করেছে।
নবার শমসের গাজীর সময়ের একটি চিঠি বা পান্ডু লিপি। যা বর্তমানে নবাব শমসের গাজীর সপ্তম বংশধরদের নিকট রক্ষিত আছে
শমসের গাজীর উত্তরসূরী মোতাহের হোসেন চৌধুরী রাশেদ বলেন, ‘আমি ছাত্র থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রাজিয়া সুলতানা আমাকে ডেকে নিয়ে নবার শমসের গাজীর একটি চিঠি হাতে তুলে দেন। যা তিনি ঢাকার যে কোন একটি জাদুঘরে পেয়ে ছিলেন। ওই চিঠিটি আমরা যত্ন করে রেখেছি। ওই চিঠিতে কি লিখা আছে বা ওই চিঠির রহস্য কি- আমরা তা জানতে পারিনি। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে আমাদের বাড়িতে শমসের গাজীর বেশ কিছু স্মৃতিচিহ্ন রক্ষিত ছিলো। কিন্তু পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সময় এসব স্মৃতিচিহ্নগুলো আমরা রক্ষা করতে পারিনি। ’
ত্রিপুরার একমাত্র মুসলিম শাসক নবাব শমসের গাজীর স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে সরকারী উদ্যোগের দাবী জানান স্থানীয় বাসিন্দা এবং শমসের গাজীর উত্তরসূরীরা।
Tags: ফেনী, ফেনী জেলা, ফেনীর ইতিহাস, শমসের গাজী
Rent for add