মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, ৩:৩৪:৫১
رَحِمَ اللَّهُ قُسَّ بْنَ سَاعِدَةَ مَا أَنْسَاهُ، وَكَأَنِّي أَنْظُرُ إِلَيْهِ بِسُوقِ عُكَاظٍ فِي الشَّهْرِ الْحَرَامِ عَلَى جَمَلٍ لَهُ أَوْرَقَ أَحْمَرَ وَهُوَ يَخْطُبُ النَّاسَ
“কুস ইবন সায়িদার ওপর আল্লাহ রহম করুন। কী-ভাবে তাকে ভুলতে পারি! যেনো আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি ওকাযের বাজরে; পবিত্র মাসে একটি লাল-পশমি উটের উপর আরোহন করে তিনি জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা করছেন’ [ইবনুন নাঈম, দালাইল, ৫৫]।
কুস ইবন সায়িদার সাথে নবীজির (সা.) সাক্ষাত বিষয়ক বর্ণনাগুলো বাইহাকী ও তাবরানীসহ বিভিন্ন হাদীসের গ্রন্থাবলি এবং ইবন সাইয়্যিন-নাসের ‘উয়ূনুল আসার’ নামক সীরাত গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। বর্ণনাগুলো ভিন্ন ভিন্ন সূত্র হলেও প্রত্যেকটিতে মুহাম্মদ ইবন হাজ্জাজ, সাঈদ ইবন হুবারা, কাসিম ইবন আব্দিল্লাহ ও আহমদ ইবন সাঈদ এ চারজন বর্ণনাকারীর কোনো একজনের উপস্থিতির কারণে ঘটনাটি জাল হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে।
ইবনুল জাওযী তার ‘মাওযূআত আল-কুবরা’ গ্রন্থে ঘটনাটি উদ্ধৃত করলেও ভিন্ন একটি সনদে ‘আল-মুনতাজাম’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
আহমদ ইবন হাম্বলের ‘কিতাবুয যূহদ’ ও ইবন নাঈম ‘দালাইল’ গ্রন্থে এমন দু’টি ভিন্ন সনদে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে যাতে চারজন জালকারীর কারও উপস্থিতি নেই। ইমাম আশ-শাওকানী তাঁর ‘আল-ফাওয়ায়িদ’ গ্রন্থে হাদীসটি সন্নিবেশিত করায় নবী জীবনে ‘কুস ইবন সায়িদা’র সাক্ষাত সাব্যস্ত হওয়ার ধারণাটি জোরদার হয়ে উঠে।
‘ওয়াফ্দুল আয়াদী’ নবম হিজরীতে মাদীনায় আসা একটি প্রতিনিধি দল। কুস ইবন সায়িদা আল-আয়াদীর গোত্রের হিসেবে এ নাম। নবী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মদীনায় বসে কথা হচ্ছিলো নবুওয়াত লাভের অল্প পূর্বের এক স্মৃতি নিয়ে। ঘটনাটি মক্কার বিখ্যাত বাজার ওকাযের। নবীজি (সা.) এখানে কুস আল-আয়াদীকে একটি লালচে উটের ওপর বসে জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে দেখেছেন। তাঁর বক্তৃতার শব্দগুলোতে ছিলো তাওহীদের প্রতি সমর্থন। ‘তিনি এমন কথা বলেছিলেন, যাতে (ঈমানের) স্বাদ ছিলো’।
নবীজি (সা.) তাঁর বক্তৃতা ও আবৃত কবিতার পংক্তিগুলোর স্মৃতিচারণ করলেন। সাহিত্য ও বক্তৃতামালার গ্রন্থগুলোতে সে বক্তৃতা ও কবিতা নিপুণতা আর শিল্পরসের রসদ হয়ে আছে। বক্তৃতার শব্দগুলো এতো ছোট ছোট এবং চমৎকার গ্রথিত যে তা ঈমান সমৃদ্ধ হৃদয়কে আন্দোলিত করে। আর বক্র হৃদয়কে করে প্রতারিত।
খৃষ্টান ঐতিহাসিকরা যেমনটা দাবি করেছেন, নবীজি (সা.) কুরআনের বাচনভঙ্গি সে কুস আল-আয়াদী থেকে আয়ত্ব করেছিলেন [শিবলী নোমানী, সীরাতুননবী]। মাআযাল্লাহ।
অথচ সত্য হচ্ছে, জাহিলী যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ইমরুল কাইস কুরআন নাযিলের পর কবিতা চর্চা বন্ধ করে দিয়েছিলেন! তার অভিব্যক্তি ছিলো কুরআনের সামনে কীসের কবিতা! এটাতো কোনো মানুষের ভাষা নয়!
কুস আল-আয়াদী সেসব ব্যক্তিদের অন্তর্গত যারা তাওহীদের শেষ চিহৃটুকু হৃদয়ে ধরে রেখেছিলেন। নবীজি (সা.) প্রতিনিধি দলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কুস ইবন সায়িদা আল-আয়াদীর’ কী খবর?’ তারা বললো, ‘মৃত্যু হয়েছে তার, হে আল্লাহর রাসূল!’ নবীজি (সা.) তার জন্য দুআ করলেন, ‘আল্লাহ তাআলা কুস ইবন সায়িদার ওপর রহমত বর্ষণ করুন, আমি প্রত্যাশা করি, কিয়ামতে দিন তিনি এক-ই উম্মাহর হয়ে আসবেন’ [ইবনুন নাঈম, দালাইল, ৫৫]।
এ ঘটনার পূর্বে নবী জীবনে অন্তত আরও দু’টি স্মৃতিতে ‘ওকায বাজার’ জড়িয়ে আছে। নবীজির দুধমাতা হালীমা আস-সাদিআর (রা.) বাড়িতে যাওয়ার পথে ছিলো বাজারটি। সম্ভবত দ্বিতীয়বার সে গৃহে যাওয়ার পথে আম্মাজান কৌতুলবশত এক গণকের স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন, যিনি নবীজিকে (সা.) দেখে সনাক্ত করতে পেরেছিলেন তাঁর ভবিষ্যত [মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক, ৯৭১৮; বাইহাকী, আল-দালায়িল, ১/৮৫]!
হয়তো আম্মাজান পরবর্তীতে মেলার সময় নবীজিকে (সা.) নিয়ে ওকাযে এসেছিলেন সে গণকের কাছে! বনু হুযাইলের সে গণকের চিৎকার শুনে ভিড় জমে গিয়েছিলো ওকাযে! ‘হে হুযাইল গোত্র! হে ওকাযের অধিপতিরা! হে আরবরা! হত্যা করো এ বালকটিকে, নচেত রাজ্য তার হস্তগত হবে’।
লোকেরা খুঁজতে শুরু করলো চুতর্দিকে! কে সে গোলাম? কোথায় গেলো সে!’ গণক বারবার বলতেছিলো, ‘আহ্! আমিতো কেবল-ই তার ভাগ্য দেখলাম’। কিন্তু তার কথায় কোনো আস্তা পেলো না জনতা। আম্মাজান তাকে নিয়ে দ্রুত গৃহের পথে সরে পড়লেন’ [তাবাকাত, ১/৭২]।
তারপর নবীজির (সা.) বিশ বছরের সময় আরবদের শেষ ‘হারবুল ফিজার’। ঐতিহাসিকদের মতে সে স্থানটা ছিলো ওকাযের বাজার। নবীজি (সা.) চাচাদের সাথে সে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন [বাইহাকী, আস-সুনান আল-কুবরা, ১২১১০]। তবে চাচাদের বূর্য্য ঠিক কোথায় ছিলো তা সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
ওকায বাজার! মক্কার বাজার! জাহিলী যুগের শ্রেষ্ঠ বাজার! এটা ছিলো কবিতার উৎসব। জাহেলি যুগে আরবদের প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণের একটি ছিলো বাগ্নিতা ও কাব্যপ্রেম। এ কাব্যপ্রেম আর বাগ্নিতার কেন্দ্র ছিলো ওকাজ বাজার।
এ মেলায় যারা কবিতা মুখস্থ বলতে পারতেন তারা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হতেন। কবিতাপাঠ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের কবিতা নামসহ কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। আরবী কাব্যের ইতিহাসে ‘সাবআ মুআল্লাকাা’ সে রকম সাতটি কাব্য যা কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো।
সে সাত কবি ছিলেন: ইমরুল কায়িস, ত্বরফা ইবন আল আবদ, যুহাইর ইবন আবি সুলমা, লাবিদ ইবন রাবিয়া, আমর ইবন কুলসুম, হারিস ইবন হিল্লিজা, আনতারা ইবন সাদ্দাদ। ঐতিহাসিক হিট্টি ওকাযকে প্রাচীন আরবের ‘একাডেমিক ফ্রেঞ্চাজ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। নবীজি (সা.) সে কবিতার মঞ্চের কাছাকাছি ছিলেন।
ওকায বাজার! এখানে পুরুষ কবি ছিলেন! নারী কবি ছিলেন! এমন নারী কবি যিনি পুরুষদেরও অতিক্রম করেছেন [বাশশার বিন বুরদের মন্তব্য]! তিনি জিন ও মানুষের কবি আল-খানসা! তাঁর পুরো নাম তুমাদির বিনত আমর ইবন হারিস ইবন শারিদ আল সুলামিয়া। ৫৭৫ খৃস্টাব্দে নজদের বিখ্যাত সুলাইম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। ভাই শাখর এবং মুয়াবিয়ার জন্য লেখা শোককবিতার কারণে আল-খানসা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
তৎকালীন আরব সভ্যতার বিভিন্ন উপাদান যেমন ধুলাবালু, ঝড়বৃষ্টি, উট-তরবারি, পাহাড়-পর্বতের দৃষ্টিনন্দন ক্যানভাস তার কবিতার চরনে ফুটে ওঠে। ওকাযে কবি খানাসার তাঁবুর বাইরে বিশেষ পতাকা উত্তোলন করা হতো। তিনি ছিলেন নবীজির (সা.) সমসাময়িক ওকায কবি। ৬২৯ সালে মদীনায় নবীজির (সা.) সান্নিধ্যে এসে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
৬৩৬ খৃস্টাব্দে পারস্যের সাসনীয় সম্রাটের বিরুদ্ধে দুঃসাহসী অভিযানে খানসার চার ছেলে শাহাদাত করেন। আল-খানাসা শেষ শোকগাথাঁ রচনা করেছিলেন আনন্দ চিত্তে, ‘আল্লাাহর প্রশংসা, যিনি তাদের শাহাদাতের মাধ্যমে আমাকে সম্মানিত করেছেন। আমি কামনা করি আমার প্রভু তার দয়ায় তাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটাবেন।’
ওকায! এখাকার শ্রেষ্ঠ কবিদের তালিকার শীর্ষে ছিলেন কবি তুরাফা! তাফসীরকারগণ পবিত্র কুরআনের ‘আর আমরা তাঁকে কাব্য রচনা করতে শিখাইনি এবং এটা তার পক্ষে শোভনীয়ও নয়। [সূরা ইয়াসীন: ৬৯]’
আয়াতের ব্যাখ্যায় আম্মাজান আইশা (রাঃ) থেকে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। কবি তুরাফার একটি চরণ নবীজি (সা.) প্রায় আওড়াতেন: ‘ سُتُبْدِي لَكَ الأَيَّامُ مَا كُنْتَ جَاهِلا وَيَأْتِيكَ بِالأَخْبَارِ مَنْ لَمْ تُزَوِّدِ ’ অর্থাৎ ‘সময় তোমার নিকট শীঘ্র-ই প্রকাশ করবে, যা তুমি অবগতহীন ছিলে। আর তোমার কাছে এসব সংবাদ বয়ে আনবে পাথেয়শুন্য (অপ্রত্যাশিত) কোনো আগুন্তক’ [আব্দুর রাজ্জাক আস-সানআনী, তাফসীরুল কুরআন, ২৪২২]।
ওকায! নবীজি (সা.) কী ওকায বাজারে কোনো ক্রয়-বিক্রয় করেছেন? যায়িদ ইবন হারিসা (রা.)-এর জীবনের একটি ঘটনা দেখা যাক। নবীজি (সা.) তাকে প্রথম দেখেছেন ওকায বাজারে! আম্মাজান খাদিজাকে (রা.) অবহিত করে নবীজি (সা.) বলেন,
“يَا خَدِيجَةُ , رَأَيْتُ فِي السُّوقِ غُلامًا مِنْ صِفَتِهِ كَيْتُ وَكَيْتُ ، يَصِفُ عَقْلا وَأَدَبًا وَجَمَالا ، وَلَوْ أَنَّ لِي مَالا لاشْتَرَيْتُهُ ”
“বাজারে একটি ছেলেকে দেখেছি, বুদ্ধিদীপ্ত, শিষ্টাচারী, নিপুণ; অর্থ থাকলে তাকে কিনে আমি নিতাম” । [ইবন আসামির, তারীখ দিমাশক, খ. ১০, পৃ. ১৩৭]।
ওকায! জাহিলী যুগে শিল্প-সংস্কৃতি এবং সাহিত্য আড্ডার প্রাণকেন্দ্র! এখানে আসতো পুরুষেরা, আসতো নারীরা, আসতো শিশু-কিশোরেরা! শিশু-কিশোরদের কুস্তি খেলা আয়োজনের জন্য এক ব্যক্তির প্রসিদ্ধি ছিলো! তাঁর নাম ছিলো ‘উমাইর’! লোকদের মাঝে তিনি ‘আল-আ‘সার ওয়াল আইসার’ [কঠোর-নম্র] নামেও পরিচিতি পেয়েছিলেন [তাবাকাত ইবন সাদ, ৩/১৭৪]! আপনি কী জানেন সে ব্যাক্তিটি কে?
“কাতাদাহ বর্ণনা করেন, ‘উমর (রা.) মসজিদু নববী থেকে বের হলেন। সাথে ছিলেন জারুদ আল-আবদী (রা.)। রাস্তায় একজন পোশাকাবৃত নারীর সাথে দেখা! উমর (রা.) তাঁকে সালাম দিলেন কিংবা তিনি উমরকে সালাম দিলেন আর উত্তর বিনিময় হলো। তারপর সে নারী বললেন, ‘ওহে! হে উমর! আমি তোমাকে জানি! ওকাযের বাজারে তোমার নাম ছিলো উমাইর! তুমি শিশু-কিশোরদের কুস্তি খেলাতে। তারপর কয়েকটি দিন-রাত না গড়াতেই তুমি উমর! তারপর কিছুকাল অতিবাহিত হতেই তুমি ‘আমীরুল মুমিনীন’!
জনগণের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। জেনে রেখো, ‘যে প্রতিশ্রুত সময়কে ভয় করে, দূরুত্ব তার কমে আসে। আর যে মৃত্যুকে ভয় করে, সে হারানোর ভয়ে কম্পমান’। এ শুনে উমর (রা.) কেঁদে দিলেন। জারুদ তখন বললেন, ‘ওহে! তুমি বেশি কথা বললে! তুমি আমীরুল মুমিনীনকে কাঁদিয়ে ছাড়লে!’ উমর (রা.) বলে উঠলেন, ‘তুমি কী এ নারীকে চিনো? তিনি খাওলা বিনত হাকীম! উবাদাহ ইবন সামিতের (রা.) সহধর্মীনী! যার কথা আল্লাহ আকাশ থেকে শুনতে পেয়েছিলেন। উমর তো তার কথা শুনার অধিক উপযুক্ত! [ইবন শাব্বাহ, তারীখ আল-মদীনা, ১১/২২৫; ইবন কুদামা, ইসবাত সিফাতিল উলু, ১/১৫১]।
ওকায! নবীজির (সা.) নবুওয়াত লাভের পরের সময়! সকাল-সন্ধ্যায় ওকাযে ঘুরে ঘুরে দাওয়াত দিচ্ছেন। আর আবূ লাহাব নবীজির (সা.) বিরোধীতায় বলে যাচ্ছেন! ‘এ সে ব্যক্তি, অন্য একটি দ্বীনের দিকে তোমাদের ডাকছেন; তোমাদের পিতৃ-পুরুষের দ্বীনের বিরুদ্ধে’। রাসূলুল্লাহ তাকে এড়িয়ে থাকছেন [মারিফাতুস সাহাবা, ১২২]। কী এক আশ্চর্য চিত্র! অথচ এ বাজারের বক্তৃতা মঞ্চে-ই নবীজির আত্মপ্রকাশের সুসংবাদ দিয়ে বক্তৃতা করেছিলেন কা’ব ইবন লুয়াই [ইবনু আল-জাওযী, মুসিরুল গিরাম, ১৪৩]।
ওকায! নবীজির (সা.) আহবানে সেখানে সাঁড়া দিয়েছেন ‘আমর ইবন আবাসা আল-সুলাইমী’! তিনি বর্ণনা করেন: ‘ওকাযে আমি রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে আসলাম। প্রশ্ন করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এ বিষয়ে কে আপনার অনুসরণ করেছে? নবীজি (সা.) বললেন, ‘দু’জন পুরুষ; একজন স্বাধীন আবূ বকর, আরেকজন দাস বিলাল’। আমর বললেন, ‘আমি সেখানে ইসলাম গ্রহণ করলাম’ [মুসতাদরাক, ৪৩৫৭]।
এ সে ওকায! নবীজি (সা.) তায়িফ থেকে ফিরছিলেন! সেদিন আকাশ থেকে জিনদের সংবাদ সংগ্রহে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছিলো! আকাশ থেকে তাদের ওপর উল্কা নিক্ষেপ হতে লাগলো। কোথায় কী হয়েছে? তার খোঁজে পূর্বে-পশ্চিমে প্রান্তে-প্রান্তে তারা ছড়িয়ে পড়লো! নাসিবীনের জীনেরা তিহামা অভিমুখে ওকাযে যাচ্ছিলো। নাখলায় তারা কুরআনের বাণী শুনতে পেয়েছিলো। তারা স্বজাতির কাছে ফিরে গিয়ে জানালো আকাশের সাথে বিচ্ছিন্নতার হেতু, ‘আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি। যা সঠিক পথ-নির্দেশ করে; ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আর আমরা কখনো আমাদের প্রতিপালকে সাথে কোনো শরীক স্থাপন করব না।’ [সূরা জিন: ১-২]। নবীজি (সা.) নামাজান্তে ওকায অভিমুখে বের হলেন। তারপর তিনি মক্কায় ফিরে এলেন [বুখারী, ৭৩৪]।
ওকায! জাহিলী যুগের বাজার! ইসলামী যুগের বাজার! কুরআন এ বাজারের বাণিজ্যের সংশয় নিরসন করেছে! সুবহানাল্লাহ। ‘ইবন আব্বাস বলেন, ‘যুল মাজাজ আর ওকায ছিলো জাহিলী যুগের মানুষের বাণিজ্য কেন্দ্র। ইসলাম যুগে তাতে বাণিজ্য করতে মানুষেরা অপছন্দ করছিলো। এমনকি আয়াত নাযিল হলো হজ্জের সময় ‘তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ কামনায় কোন দোষ নেই [বাকারা: ১৯৮]’ [বুখারী, ১৭৭০]।
ওকায! আরবদের প্রতি বছরের ওকায! পরস্পরের বড়াই-গর্বের ওকায! বংশীয় কৌলিন্য আর গৌরব প্রকাশের ওকায! এসব কারণে তোমার নাম ওকায। যূল কুদা মাসের প্রথমে আরবেরা বিশ দিননের জন্য একসাথ হতো ওকাযে। তারপর ‘মিজান্না’ বাজারে যূল কুদার বাকি দশটি দিন। তারপর যূল হজ্জ মাসের আটদিন যূল মাজাজে কাটিয়ে হজ্জ পালন করতো। তায়িফ থেকে চল্লিশ কিলোমিটার উত্তরে স্থানটির অবস্থান। কারনুল মানাযিল তথা বর্তমান ‘সাইল আল-কাবীর’-এর পিছনে তা অবস্থিত। মক্কা থেকে তা দক্ষিণ-পূর্বে এক দিনের পথ তথা চব্বিশ মাইল (একচল্লিশ কিলোমিটার) দূরুত্বে ‘আল-আসীদাহ’ নামক এলাকায় অবস্থিত।
উমর (রা.) তাঁর খিলাফতকালে ওকায বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারপর প্রায় ১৩০০ বছর পর বাদশা আব্দুল্লাহ ইবন আব্দিল আজীজের সময় ভ্রমণকেন্দ্র বিবেচনায় নিয়ে পুরোনো ওকাযের স্থানে-ই তা আবার চালু করা হয়। সম্প্রতি ২০১৯ সনে ব্যাপক পরিসরে ওকায চালু করা হয়েছে। ‘আল-জাহিজ অ্যান্ড দ্যা বুক অব অ্যানিমেল’ শীর্ষক এ মেলায় আল-জাহিজের আরবিতে লিখিত বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন কিতাব আল-হাইয়াওয়ান-এর বিভিন্ন আলোচ্য বিষয় আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে দৃশ্যায়ন করা হয়।
আল-জাহিজের আসল নাম আমর ইবন বাহর আল-কিনানি। আল-জাহিজ নামেই তিনি বেশি পরিচিত। তিনি নবম শতকের একজন আরব গল্পকার ও প্রাণিবিজ্ঞানী। গ্রন্থটিতে তিনি ৩৫০টিরও অধিক প্রাণী সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। সৌদি আরব সহ মিশর, জর্ডান, মরোক্কো, তিউনিশিয়া, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, বাহরাইন, কুয়েত ও লেবানন এগারটি দেশ ওকাযে অংশ নিয়েছে । এসকল দেশের শতাধিক প্রতিষ্ঠান তাদের হস্তশিল্প, রন্ধনসম্পর্কীয় দক্ষতা, সঙ্গীত, শিল্পকলা এবং পর্যটন শিল্পের বিভিন্ন সামগ্রীর পসরা সাজিয়েছিলো।
ওকায নবী জীবনের স্মৃতি বিজড়িত স্থান। ওকায নবীজির ক্রয়-বিক্রয়ের স্থান। ওকায নবীজির দাওয়াতের ময়দান। ওকায কী পারবে সীরাতের সে স্মৃতির আলোকে আগামী দিনগুলোতে দ্যুতি ছড়াতে? ওকাযের ভবিষ্যত যেন ইসলামের জন্য হয়।
❣️ সাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মদ ????
Tags: নবিজীর ব্যবসায়িক জীবন, মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক, সিরাতে রাসুল (সঃ)
Rent for add