• ঢাকা, সোমবার, ২০ জানুয়ারি ২০২৫

কাবাগৃহ পুনর্নির্মাণে নবীজির মধ্যস্থতা


ঘটনাটি নবীজি (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তির আগের। তখন নবীজি (সা.)-এর বয়স ৩৫ বছর। পাহাড় থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানির স্রোতের আঘাতে তৎকালীন কাবাঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখনকার কাবাঘরে কোনো ছাদও ছিল না, ফলে কিছু চোর দেয়াল টপকে কাবাগৃহে প্রবেশ করে এবং সেখানে রক্ষিত মূল্যবান মালামাল ও অলংকারাদি চুরি করে নিয়ে যায়।

এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ইতিপূর্বে আর ঘটেনি। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় কুরাইশ নেতারা কাবাগৃহ ভেঙে পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ইবরাহিম ও ইসমাঈলের হাতে গড়া প্রায় আড়াই হাজার বছরের স্মৃতিধন্য এই মহা পবিত্র গৃহ সংস্কারের ও পুনর্নির্মাণের পবিত্র কাজে সবাই অংশীদার হতে চায়।

বিষয়টি সামনে রেখে কুরাইশ নেতারা বৈঠকে বসেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এর নির্মাণকাজে কারো কোনো রকম হারাম সম্পদ ব্যয় করা হবে না। তাঁরা বলেন, হে কুরাইশগণ! তোমরা এর নির্মাণকাজে তোমাদের পবিত্র উপার্জন থেকে ব্যয় করো। এর মধ্যে ব্যভিচারের অর্থ, সুদের অর্থ, কারো প্রতি জুলুমের অর্থ মিশ্রিত কোরো না।’ (ইবনু হিশাম : ১/১৯৪)

অতঃপর কোন কোন গোত্র মিলে কোন পাশের দেয়াল নির্মাণ করবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে এবার ছাদ নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা ইতিপূর্বে ছিল না। কিন্তু কে আগে দেয়াল ভাঙার সূচনা করবে? অবশেষে অলীদ বিন মুগিরাহ মাখজুমি সাহস করে প্রথম ভাঙা শুরু করেন। তারপর সবাই মিলে দেয়াল ভাঙা শেষ করে ইবরাহিম (আ.)-এর স্থাপিত ভিত পর্যন্ত গিয়ে ভাঙা বন্ধ করে দেন। অতঃপর সেখান থেকে নতুনভাবে সর্বোত্তম পাথর দিয়ে ‘বাকুম’ নামক এক রোমক কারিগরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণকাজ শুরু হয়।

কিন্তু গোল বাধে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ‘হাজারে আসওয়াদ’ স্থাপনের পবিত্র দায়িত্ব কোন গোত্র পালন করবে সেটা নিয়ে। এই বিবাদ অবশেষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গড়াবার আশঙ্কা দেখা দিল। তখন প্রবীণ নেতা আবু উমাইয়া মাখজুমি প্রস্তাব করলেন, আগামীকাল সকালে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম ‘হারামে’ প্রবেশ করবেন, তিনিই এই সমস্যার সমাধান করবেন। সবাই এ প্রস্তাব মেনে নিল।

আল্লাহর অপার মহিমা। দেখা গেল যে, বনু শায়বাহ ফটক দিয়ে সকালে সবার আগে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন সকলের প্রিয় ‘আল-আমিন’। কাবা নির্মাণে অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী রাবী আব্দুল্লাহ বিন সায়েব আল-মাখজুমির বর্ণনা মতে তাঁকে দেখে সবাই বলে উঠল—‘এই যে আল-আমিন। আমরা তাঁর ওপর সন্তুষ্ট। এই যে মুহাম্মাদ।’

অতঃপর তিনি ঘটনা শুনে একটা চাদর চাইলেন এবং সেটা বিছিয়ে নিজ হাতে ‘হাজারে আসওয়াদ’ উঠিয়ে তার মাঝখানে রেখে দিলেন। অতঃপর নেতাদের বললেন, আপনারা সবাই মিলে চাদরের চারপাশ ধরে নিয়ে চলুন। তা-ই করা হলো। কাবার কাছে গেলে তিনি পাথরটি উঠিয়ে যথাস্থানে রেখে দিলেন। এই দ্রুত ও সহজ সমাধানে সবাই সন্তুষ্ট হয়ে মুহাম্মদের প্রশংসা করতে করতে চলে গেল।

আরবরা এমন এক যুদ্ধ থেকে বেঁচে গেল, যা ২০ বছরেও শেষ হতো কি না সন্দেহ। এ ঘটনায় সমগ্র আরবে তাঁর প্রতি ব্যাপক শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠল। নেতাদের মধ্যে তাঁর প্রতি একটা স্বতন্ত্র সম্ভ্রমবোধ সৃষ্টি হলো। উল্লেখ্য যে, নবুয়ত লাভের পূর্ব পর্যন্ত কুরাইশগণ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে শ্রদ্ধাভরে আল-আমিন বলেই ডাকত।’ (ইবনু হিশাম : ১/১৯৮)

কাবাগৃহ নির্মাণের এক পর্যায়ে উত্তরাংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত বনু ‘আদি বিন কাব বিন লুওয়াই তাদের হালাল অর্থের কমতি থাকায় কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে মূল ভিতের ওই অংশের প্রায় সাত হাত জায়গা বাদ রেখেই দেয়াল নির্মাণ করা হয়, যা হাতিম বা পরিত্যক্ত নামে আজও ওইভাবে আছে। সে কারণে হাতিমের বাহির দিয়েই তাওয়াফ করতে হয়, ভেতর দিয়ে নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয়ের পরে ওই অংশটুকু কাবার মধ্যে শামিল করে মূল ইবরাহিমি ভিতের ওপর কাবা পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নওমুসলিম কুরাইশরা সেটা মেনে নেবে না ভেবে বিরত থাকেন।’ (বুখারি, হাদিস : ১৫৮৬)

এ কারণেই বলা হয়ে থাকে, ‘মন্দ প্রতিরোধ অধিক উত্তম কল্যাণ আহরণের চাইতে।’ উল্লেখ্য, হিজরতের ১৮ বছর পূর্বে কাবাগৃহ পুনর্নির্মাণ সমাপ্ত হয়।’ (ইবনু হিশাম ১/১৯৭-এর টীকা-৩)

Tags: , , , , , , ,

Rent for add