মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ : ১৭ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৫:১৯:৩৮
সম্রাট বাবর অস্থির হয়ে আছেন। সারাদিন প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হচ্ছে, কিন্তু রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে না। ভ্যাপসা গরম আর মশার উপদ্রব অসহনীয় যন্ত্রণা দিচ্ছে। তার বাহিনীতেও এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইস্পাতদৃঢ় মুঘল বাহিনী এখানে একেবারেই মানিয়ে নিতে পারছে না। এখানের খাবারেও তারা অভ্যস্ত হতে পারছে না। তারা দ্রুত হিন্দুস্তান ত্যাগে আগ্রহী। জেনারেলদের হাবভাব দেখে বাবর বুঝতে পারছেন।
তবে, এটা তাঁর অশান্তির মূল কারণ নয়। হিন্দুস্তানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো সুবিধার নয়। বিশেষ করে মেওয়াটের মুসলিম রাজপুত রাজা হাসান খান আর মেবারের হিন্দু রাজপুত রাজা রানা সংগ্রাম সিংহ জোট বেঁধে বিদ্রোহ করেছেন। মেওয়াটের রাজপুতরা মুসলিম হলেও তারা হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এমনকি তারা হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন।
আর, রানা সংগ্রাম সিংহ ছিল এক বিশ্বাসঘাতক। সে ইব্রাহীম লোদির বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে বাবরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল- লোদীর বিশাল বাহিনীর সামনে বাবর ধ্বংস হয়ে যাবেন, লোদীর শক্তি হ্রাস পাবে আর তিনি দুর্বল লোদিকে পরাভূত করে হিন্দুস্তানের দখল নেবেন। তাই, বাবর যখন ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে লোদীর ১ লক্ষ সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন, রানা সিংহ তখন তামাশা দেখেছে।
উল্লেখ্য, রাজপুতরা কোনো একক কমান্ডের অধীনে ছিল না; তারা অনেকগুলো ছোট ছোট রাজপুত রাজ্য মিলে একটি কনফেডারেশন গঠন করেছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন এই রানা সংগ্রাম সিংহ। তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল হিন্দুস্তানের ভূখণ্ডগুলোকে রাজপুত পতাকার নিচে নিয়ে আসা। কিন্তু পানিপথের যুদ্ধে পরিস্থিতি উল্টে যাওয়ায় রানা সিংহ বাবরকে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বাবরও প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
রানা সিংহের বাহিনী বায়ানার সীমান্তে ফতেহপুর পৌঁছায় এবং মুঘল শহরগুলোতে লুটপাট চালায়, অসংখ্য মসজিদ ধ্বংস করে, ইমামদের হত্যা করে এবং নারী ও শিশুদের সাথে অশোভন আচরণ করে। বাবর বুঝতে পারেন- যুদ্ধ আসন্ন। তাঁর পুত্র হুমায়ুন জৈনপুরে অবস্থান করছিলেন। তিনি জুনায়েদ মির্জার কাছে জৈনপুরের দায়িত্ব দিয়ে দ্রুতগতিতে ১৫২৭ সালের ৬ জানুয়ারী পিতার সাথে বাহিনীতে যোগ দেন।
পানিপথে ইব্রাহীম লোদিকে সহজে পরাজিত করা গিয়েছিল। কিন্তু রণনৈপুণ্যে বিখ্যাত রাজপুতদের ক্ষেত্রে তেমন হবে না। বাবরের আমীররা অভ্যন্তরীণ বিবিধ সমস্যা আর রাজপুত বাহিনীর বিশাল আকার বিবেচনা করে যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পরামর্শ দিলেন। তারা আগ্রার নিরাপত্তায় যথেষ্ট সৈন্য রেখে পাঞ্জাবে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। আগ্রা ও পাঞ্জাবে শক্তি বৃদ্ধি করা যাবে। বাবর তার জেনারেলদের কথা মতো করলেন না।
যুদ্ধ এড়ানোর উপায় নেই। রাজপুতদের হাতে নিরীহ লোকদের হয়রাণি বাবর মেনে নিতে পারেন না। তারা মুঘলদের মোকাবিলায় হিন্দুত্ববাদের ভিত্তিতে হিন্দুদের সমর্থন আদায় করছে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চাদপসরণের অর্থ হবে নিজ ধর্মের সম্মানকে জলাঞ্জলি দেওয়া। এদিকে গোয়েন্দা রিপোর্টে জানা গেল- রাজপুতরা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের অধিক সৈন্যের বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে রণথম্বোর থেকে অগ্রসর হচ্ছে।
রাজপুত রাজাগণ রানা সিংহকে সহায়তা প্রদান করছেন। তিনি আম্বার, মারওয়ার, রামপুরা, গড়গাঁও, চান্দেরি, বুন্দি, রায়সিন, সিক্রি, আজমিরসহ অন্যান্য হিন্দু অঞ্চল থেকে বাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বিপুল অর্থ ও সেনা সাহায্য পাচ্ছেন। রাজপুত রাজা সিহলাদি ৩০ হাজার, চান্দেরির মেদিনী রাও ১০ হাজার, সুলতান মাহমুদ লোদি ১০ হাজার সৈন্য দিয়ে সংগ্রাম সিংহকে সহায়তা করেন। মুসলিম রাজপুত রাজা হাসান খান মেওয়াটি রানা সিংহকে ১২ হাজার সৈন্য দিয়ে সহায়তা করেন।
হাসান খানের পুত্র নাহার খান পানিপথের যুদ্ধে বন্দী হয়েছিল। এখন হাসান খানকে নিবৃত করার আশায় বাবর নাহার’কে বিনা শর্তে মুক্তি দেন। কিন্তু হাসান খান জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রানা সিংহের সাথে অবস্থান করে বাবরের সাথে শত্রুতা অব্যাহত রাখেন। রাজপুতরা জানতো যে, ইব্রাহীম লোদির বিরুদ্ধে পানিপথের যুদ্ধে মুঘল বাহিনী বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মুঘলদের উপরে আঘাত হানার এটাই উপযুক্ত সময়।
রাজপুতদের নিকট ১ হাজার হাতির বিরাট হস্তীবাহিনী ছিল। বাহিনীর কমান্ডারদের বেশিরভাগই ছিলেন রাজপুত রাজা। তারা জয়ের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিল। তারা খানুয়ার প্রান্তরের নিকটে পৌছে যায় এবং আগ্রার নিকটে মুঘলদের সাথে ছোটখাট সংঘর্ষে জড়াতে থাকে। নিরুপায় বাবর ১৫২৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি খানুয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিছু আফগান আমীর আর হিন্দুস্তানি মিত্র বাবরের সাথে যোগ দেন।
রাজপুতদের সমীহ করা হতো যে, তারা হিন্দুস্তানের অন্যান্যদের মতো ভীতু নয়; যুদ্ধে পরাজয়ের চেয়ে মৃত্যু তাদের কাছে শ্রেয়। মুঘল সেনারা তাদের দক্ষতা টের পায়- যখন মাধাকুরের নিকটে দেড় সহস্র সৈন্যের একটি মুঘল সেনাদল রাজপুতদের কাছে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়। রাজপুতরা ৪/৫ হাজার সৈন্য নিয়ে হঠাৎ করে এই ক্ষুদ্র বাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুঘল দলের অধিকাংশ যোদ্ধা নিহত বা বন্দী হয়।
১২ মার্চ বাবর রাজপুত বাহিনীর মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। সমগ্র রাজপুত কনফেডারেসি থেকে প্রাপ্ত সৈন্য নিয়ে শত্রু বাহিনীর আকার ছিল আক্ষরিক অর্থেই বিশাল। মুঘল বাহিনী ইতিপূর্বে এত বড় কোনো বাহিনীর মোকাবেলা করেনি। তার উপরে তারা এমন যোদ্ধা যারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে বলে যুদ্ধ করে। মুঘল বাহিনী ছিল রাজপুত বাহিনীর তুলনায় মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ।
মুঘল বাহিনী দ্বিধাগ্রস্ত হয়। অবস্থা বুঝতে পেরে বাবর তার বাহিনীর উদ্দেশ্যে একটি আবেগময় ভাষণ দেন। তিনি তার বাহিনীর যোদ্ধাদের সাথে খুবই আন্তরিক আচরণ করতেন, তাদের সাথে রাজকীয় গাম্ভীর্য বজায় রেখে অযথা দূরত্ব তৈরি করতেন না। তারা বাবরকে খুব ভালবাসত। সম্রাটের হৃদয়স্পর্শী ভাষণে তারা অত্যান্ত উজ্জ্বীবীত হয়। তারা সম্রাটকে ফেলে তারা জীবন নিয়ে পালিয়ে যাবে না বলে কথা দেয়।
১৫ মার্চ রাতে কাসিম হুসাইন ১০ ক্রোশ দূরে থেকে বাবরের নিকট প্রেরিত বার্তায় জানান যে, তিনি খোরাসান থেকে ৫০০ যোদ্ধা নিয়ে এসেছেন। বাবর এক্ষেত্রে একটি সূক্ষ্ম চাল চালেন। তিনি গোপনে ১০০০ মুঘল সৈন্য পাঠিয়ে দেন। কাসিম হুসাইন এই ১০০০ সৈন্যসহ পরেরদিন দিবালোকে বাবরের বাহিনীর সাথে মিলিত হন। বাবরের উদ্দেশ্য ছিল- শত্রু যেন ধারণা করে যে, নতুন নতুন সেনাদল আসছে!
১৬ মার্চ বাবর মাত্র ২৫ হাজার সৈন্য নিয়ে খানুয়ার প্রান্তরে সোয়া এক লক্ষ যুদ্ধবাজ রাজপুত সৈনিকের মুখোমুখি হন। নিজ বাহিনীর সম্মুখে বাবর পরিখা খনন করান। পরিখার পেছনে শিকল দিয়ে বাঁধা গরু আর ঘোড়ার গাড়ির প্রাচীর। প্রাচীরের মাঝে রিজার্ভ সেনাদের জন্য ফাঁকা জায়গা আর আড়ালে মোতায়েন করা হয় তীরন্দাজ, ম্যাচলক সেনাদল আর কিছু কামান। বাবর ডিফেন্সিভ ফরমেশন গ্রহণ করেন।
মূল বাহিনীর সেন্টারে বাবর নিজে অবস্থান গ্রহণ করেন, সাথে থাকেন চাচাত ভাই তিমুর খান। রাইট উইং কমান্ডার শাহজাদা হুমায়ুন, কাশিম খান, হিন্দাল মির্জা ও খসরু শাহ কোকুলতাশ। লেফট উইং এর কমান্ডার সৈয়দ মেহেদী খাজা, জামান মির্জা, মীর আবদুল আজিজ ও মীর মুহাম্মদ আলী খান। সম্মুখে ওস্তাদ আলী কুলী খানের নেতৃত্বে মুঘল আর্টিলারী বাহিনী। ম্যাচলক বাহিনীর কমান্ডার মোস্তফা রুমি।
অশ্বারোহী বাহিনীকে মোবাইল গার্ড হিসেবে রাখা হয়। আর, যুদ্ধ চলাকালে শত্রুর পেছনে অতর্কিত হামলা করার জন্য ফ্ল্যাংকিং ফোর্স রিজার্ভ রাখা হয়। ওদিকে প্রবল আত্মবিশ্বাসী রানা সিংহ আক্রমণের সূচনা করেন। শুরুতে তিনি হস্তিবাহিনী প্রেরণ করেন। হাজার খানেক হাতি একদম নিকটবর্তী হলে মুঘল কামানগুলো একযোগে গর্জে ওঠে। ভীত হস্তিবাহিনী যুদ্ধবিন্যাস ছেড়ে বেসামাল ঊর্ধশ্বাসে পালাতে থাকে।
হাতির পায়ের নিচে চাপা পড়ে রাজপুত সৈন্যরা গণহারে মরতে থাকে। এবার রাজপুত অশ্বারোহীরা মুঘল লেফট উইং ও সেন্টারে তীব্র হামলা করে। ম্যাচলকদের সহায়তায় তাদেরকে প্রতিরোধ করা হয়। মুঘল ফ্ল্যাংকিং ফোর্স রাজপুতদের পেছনে আক্রমণ করে, কিন্তু রাজপুত অশ্বারোহীরা তাদেরকে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করে। অবস্থান শক্ত করতে না পেরে বাবর সকল ইউনিট নিয়ে একযোগে আক্রমণ করেন।
কামানগুলো সামনে টানা হতে থাকে এবং ফায়ারিং চলতে থাকে। ফ্ল্যাংক ও ক্যাভালরি ফোর্স ডান ও বামপাশ থেকে একযোগে হামলা করে। রাজপুতরা হামলা করতে গেলে পরিখার ও প্রাচীরের ফাঁদে পরে বিপুল সংখ্যায় নিহত হয়। কিন্তু তারা কিছুতেই দমে যায়নি। তারাও একযোগে মুঘল বাহিনীর মধ্যভাগে আক্রমণ চালায়, কিন্তু বাবরের একের পর এক নতুন কৌশলের সামনে রাজপুতরা সুবিধা করে উঠতে পারেনি।
সারাদিন যুদ্ধের পর বিকালের দিকে রাজপুত বাহিনীর তেজ কমতে থাকে এবং সন্ধ্যার দিকে তাদের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। রাজপুত সৈন্যরা যেখানেই পিছিয়ে যায় মুঘল সৈন্যরা তাদের ৩/৪ কিলোমিটার পর্যন্ত ধাওয়া করে, যাতে তারা ফিরে এসে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে। সন্ধ্যায় রানা সংগ্রাম সিংহ আহত হন। রানা সিংহের বিশ্বস্ত মিত্র রাজা রায়মহল রাঠোর, উদয় সিংহ, রতন সিংহ-সহ অনেকে নিহত হন।
মেওয়াটের রাজা হাসান খান এ যুদ্ধে নিহত হন। এ যুদ্ধে জয়ের পর হিন্দুস্তানে মুঘল সাম্রাজ্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাবর ‘গাজি’ উপাধি গ্রহণ করেন। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে বাবর খানুয়ার নাম রাখেন শুকরি। এই শুকরিই পরবর্তীতে রূপ নেয় “ফতেহপুর সিক্রি”। হিন্দুস্তানে রাজপুতদের শ্রেষ্ঠত্বের যে সমীহ ছিল তা চিরতরে দূর হয়। বিশাল পরাজয়ে শক্তিশালী রাজপুত কনফেডারেসি ভেঙ্গে পড়ে।
হিন্দুস্তানের রাজনীতিতে রাজপুতদের আধিপত্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। রাজপুত শক্তি পুরোপুরি ধ্বংস না হলেও তাদের মেরুদণ্ড চিরদিনের মতো ভেঙ্গে যায়। আর, তাদের “রাজপুত শাসিত হিন্দুস্তান” এর স্বপ্ন উবে যায়। লোদীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করলেও হিন্দুস্তানে মুঘল সম্রাজ্য মোটেই স্থিরতা বা সমীহ অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু মাত্র একদিনের যুদ্ধে রাজপুতদের ধ্বংস করে দেওয়ায় সকল অর্জন নিশ্চিত হয়েছিল।
Tags: খানুয়া যুদ্ধ, দিল্লি, ফতেহপুর সিক্রি, মুঘল ইতিহাস, মুঘল শাসন, মুঘল সাম্রাজ্য, মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ, সম্রাট বাবর
Rent for add