ইতিহাস ঐতিহ্য ডেস্ক : ৫ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:২১:৫৩
জনশ্রুতিটা সেই মোগল আমলের এবং তা বাংলার আরো অনেক প্রাচীন দিঘির কাহিনির মতোই। যদিও এর সত্যতা মেলে না। বাংলার উত্তরাঞ্চলের এক রাজ্যে দেখা দিয়েছে চরম খরা। তখন ইঁদারা অর্থাৎ সাবেক কালের কূপের পানি ব্যবহার করত মানুষ। প্রচণ্ড খরার কারণে খাল-বিল, পুকুর তো বটেই, কূপের পানিও শুকিয়ে যায়।
পানির অভাবে প্রজাদের কষ্টে ব্যথিত রাজা নারায়ণ চক্রবর্তী উদ্যোগ নেন দিঘি খননের। কয়েক শ শ্রমিক দিয়ে শুরু হয় বিশাল জলাশয় খননের কাজ। তবে অনেক খননের পরও দিঘিতে পানি না ওঠায় চিন্তায় পড়ে যান। একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন, দুই কুমারী মেয়েকে দিয়ে দিঘির তলায় পূজা করলে মিলবে পানির দেখা।
পরের দিনই রাজা দুই মেয়েকে লাল ও সাদা শাড়ি পরিয়ে শুকনো দিঘিতে নামিয়ে পূজা শুরু করান। পূজার কিছু সরঞ্জাম বাকি থাকায় পুরোহিত তা রাজাকে আনতে বলেন। রাজা সরঞ্জাম আনতে প্রাসাদে যান। ঠিক তখনই দিঘির তলায় অদ্ভুত শব্দ শুনতে পায় চারপাশে উপস্থিত লোকজন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শুকনো দিঘি পানিতে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। ডুবে করুণ মৃত্যু হয় রাজার দুই মেয়ে সিন্দুর আর মতির। প্রজাদের পানির কষ্ট লাঘব হলেও দুই মেয়েকে হারানোর শোকে কাতর হয়ে পড়েন রাজা-রানি। তখন থেকে ওই পুকুরের নাম হয় সিন্দুর মতির দিঘি। এই নামে আজও সবার কাছে পরিচিত মনোরম জলাশয়টি।
সিন্দুর মতি দিঘির অবস্থান কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার হরিশ্বর তালুক ও লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রামের সীমানা লাগোয়া। প্রায় ১৫ একর আয়তনের এই দিঘির চারপাশে রয়েছে পুরনো বট-পাকুড়, আম, তেঁতুল ও বেলগাছ। একদিকে রয়েছে সিন্দুর মতির প্রতিমূর্তিসংবলিত একটি মন্দির। এ ছাড়া দিঘির পারে রয়েছে আরো কয়েকটি মন্দির ও একটি শ্মশানঘাট।
সিন্দুর মতি মন্দির পরিষদের সভাপতি অতুল কৃষ্ণ রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছর চৈত্র মাসের নবমীতে সিন্দুর মতির পূজা আয়োজিত হয়। এ উপলক্ষে দিঘির পাড়ে বিরাট মেলার আয়োজন করে পূজা কমিটি। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এসে শান্তি লাভের আশায় দিঘিতে স্নান করে। মানত হিসেবে অনেকে পাঁঠা বলি দেয়। বহুকাল ধরে এই প্রথা চলে আসছে।
১৯৭৫ সালে সিন্দুর মতি দিঘিটি সরকারি উদ্যোগে সংস্কারের সময় সেখানে কিছু মূল্যবান মুদ্রা, মূর্তি ও পাথর পাওয়া যায়। নিদর্শনগুলো জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে দিঘির উত্তর পাশের ঘাট পাকা করার সময় প্রাচীন একটি ঘাটের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান পাওয়া যায়। কয়েকটি অক্ষত সাদা পাথরও উদ্ধার করা হয় তখন।
স্থানীয় জনশ্রুতিতে বলা হয়, রাজা নারায়ণ চক্রবর্তী নিঃসন্তান থাকার সময় সন্তান লাভের আশায় স্ত্রী মেনকা দেবীকে নিয়ে তীর্থস্থান ভ্রমণে বর্তমান সিন্দুর মতি দিঘির পূর্ব পাশে অবস্থিত দেউল সাগর মন্দিরে যান। তখনকার বড় তীর্থস্থান দেউল সাগর মন্দির বর্তমানে বিলুপ্ত। পরবর্তী সময়ে রাজা নারায়ণ চক্রবর্তী সেখানেই আবাসস্থল গড়ে তোলেন। দিনে দিনে বড় হয় তার রাজত্ব।
লোককথায় আরো বলা হয়, মেয়েদের দিঘির পানিতে ডুবে মৃত্যুর পর সে রাতেই আবার এক স্বপ্ন দেখেন রাজা। স্বপ্ন থেকে তিনি জানতে পারেন, তার কন্যাদের আসলে মৃত্যু হয়নি। তারা দিঘির তলায় দেবত্বপ্রাপ্ত হয়ে অমরত্ব লাভ করেছে। রাজা তার মেয়েদের দেখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। কয়েক দিন পর মতি তার বোন সিন্দুরের লাল শাড়ির আঁচল এবং সিন্দুর তার ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুল পানির ওপর তুলে ধরে। তখন থেকে যুগ যুগ ধরে সিন্দুর মতির এমন দুটি মূর্তিতে প্রতিবছর পূজা করে আসছে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহন্ত কুমার, নিখিল চন্দ্র ও মুকুল চন্দ্র বলেন, এই দিঘির পানি কখনো শুকায়নি বলে তারা বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছেন। সারা বছর দিঘি পানিতে ভরা থাকে। তারা শুনেছেন, একবার দিঘি শুকানোর জন্য ২২টি শ্যালো মেশিন লাগিয়ে কয়েক দিন চেষ্টা করেও পানি তুলে শেষ করা যায়নি।
Rent for add